ইতিহাস ও ঐতিহ্য

সানকিতে খাবার খাওয়ার বহুবিধ উপকার

সানকি হচ্ছে পোড়ামাটির তৈরি এক ধরনের পাত্র। উপমহাদেশীয় মৃৎশিল্পের সবচেয়ে প্রাচীন ও উল্লেখযোগ্য একটি উপাদান হচ্ছে এই সানকি। বর্তমানে সিরামিক, চীনামাটি ও মেলামাইনের যুগে এই মাটির সানকির চাহিদা কিছুটা কমলেও কদর ও সৌন্দর্য কিন্তু কমেনি। বাঙালি জাতির সংস্কৃতি এবং রুচিবোধের একটি অন্যতম ধারক ও বাহক এই মাটির সানকি। কিশোরগঞ্জে এখনোও এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে অনেকেই। 

কয়েক বছর আগেও মাটির হাঁড়ি, পাতিল, কলস, কুজো, সরা, মালশা, জগ ইত্যাদি মাটির তৈরি অনেক কিছুর ব্যবহার দেখা যেত কিশোরগঞ্জের গ্রামে-গঞ্জে, এমনকি মফস্বলগুলোতেও মাঝে মাঝে এসবের ব্যবহার দেখা যেত। দ্রুতগতিতে বাণিজ্যের প্রসারে বিভিন্ন ধাতু বা প্লাস্টিক পণ্যের বিজ্ঞাপনসমূহ উপকারী জিনিসের চেয়ে চাকচিক্য ও টেকসই বস্তুর প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে এক শতাব্দীর ব্যবধানে সেসব আসবাবপত্র, বাসন-কোসনে মাটির পরিবর্তে তামা, প্লাস্টিক, দস্তা, লোহা, স্টিলসহ বিভিন্ন ধাতু স্থান পেয়েছে। বর্তমান মাটির তৈরি বাসন-কোসন ব্যবহারের প্রচলন সংহার প্রায়। অথচ মাটির পাত্র ব্যবহার করা মানব দেহের জন্য ব্যাপক স্বাস্থ্যবর্ধক। বিশেষ করে মাটির তৈরি পাত্রে খাবার রান্না করা ও খাওয়া এবং মাটির তৈরি পানির পাত্রে পানি রাখা ও পান করা অন্য সকল ধাতুর পাত্রের অপেক্ষা মানব দেহের জন্য উৎকৃষ্ট। মাটির তৈরি বাসন-কোসন বা আসবাবের ব্যবহার এ অঞ্চলের গণ-মানুষের ঐতিহ্যও ছিল বটে।

জেলা সদরের খিলপাড়া গ্রামে দেখা মিলে, মেইন রোডের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কাঁধে মাটির হাঁড়ি পাতিল নাম তার সুবেদার। দেখতে জীর্ণ শীর্ণ হলেও ভার কাঁধে বেশ বেগেই হেঁটে চলেছেন।জিগ্যেস করলে তিনি বলেন,মাটির জিনিস পত্রের মধ্যে মাটির তৈরি প্লেট বা সানকির চাহিদা মোটামুটি ভালো,পাশাপাশি মাটির ব্যাংক,আর অন্যান্য জিনিসপত্র কম বিক্রি হয়। সর্বোপরি ডিজিটালের ছুঁয়াই এ পেশায় শান্তি নাই।

জানা যায়, মাটির পাত্র শতভাগ প্রাকৃতিক এবং বিষমুক্ত। অন্যদিকে স্টিলে তৈরি হয় অনেক ধরনের ধাতু যেমন আয়রন, নিকেল, ক্রোমিয়াম, কার্বন ইত্যাদির মিশ্রণে। এসবের সামান্য পরিমাণ উপস্থিতিতে বিষদ পরিমাণ বিষ থাকে। যা কিডনি রোগ, লো-পেসার, পেশিকম্পন, ক্যান্সার ও ত্বকের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। মেটাল, সিরামিক পাত্র বা কড়াইতে রান্না করলে বা খাবার রাখলে ক্রোমিয়াম, নিকেল, টাইটেনিয়াম, এ্যালুমেনিয়াম, ক্যাডমিয়াম অথবা রাসায়নিক ও সিসার মতো ধাতু খাবারে মিশে যায়। আর প্লাস্টিক তো পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য হুমকি। মাটির পাত্র তাপে নিষ্ক্রিয় থাকায় খাবারের খনিজ ও পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্য থাকে। খাবারের সঙ্গে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম ইত্যাদি খনিজ পদার্থ থাকে যা আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য, মাটির পাত্রে রান্না করলে খাবারের এসব খনিজসমূহ অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু ধাতুর পাত্রে রান্না করার সময় তাপের বিশেষ মাত্রায় খাদ্য ও জল দ্রবণীয় পুষ্টির মূল অংশ স্থির না থেকে বাষ্পের সঙ্গে উড়ে যায়। অধিক তাপে ধাতু প্রতিত্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সুতরাং রান্নার সময়ও তাপের একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় খাবারে থাকা খনিজ পদার্থের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার ফলে খাবারের গুণগত মান ক্ষুণ্য হয় এবং আয়রন উৎপাদিত হয়। যা আমাদের শরীরে জমে থেকে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের সাহেবের চর গ্রামের আলেক মিয়া(৮০) এর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়,মাটির সানকিতে খাবার খাচ্ছেন তিনি বলেন, আমার বাপ-দাদার যুগে ঘরে ঘরে মাটির আসবাবপত্র, বাসনকোসন ব্যবহার হতো কারন এটা নির্ভেজাল।কালের বিবর্তনে এটা হারিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমি এখনও মাটির পাত্রেই খাবার খাই,এতে আমার আর যায় হোক খাবারে তৃপ্তি আসে।

কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় খবর নিয়ে জানা যায়,এখনও প্রায় প্রতিটি গ্রামেই কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ  মাটির পাত্রে রান্না ও খাওয়ার প্রচলন ধরে রেখেছে।

জেলার হোসেনপুর উপজেলার মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রেতা দোকানী নিবাস চন্দ্র পাল জানান,মাটির তৈরি জিনিসপত্রের মাঝে সানকিটাই বেশি বিক্রি হয়।এ ব্যবসায় সংসার চালানো দায়,কৃষি কাজের পাশাপাশি দোকানটা চালাই।আধুনিকতার ভিরে হারিয়ে গেছে যাচ্ছে মৃৎশিল্প। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ্যালুমিনিয়াম (দস্তা) ও আলজেইমের রোগের মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। মাটির পাত্র সেদিক দিয়ে পুরোপুরি দ্বিধামুক্ত। মাটির পাত্রে রান্না একটি আঁটসাঁট রান্নার পরিবেশ তৈরি করে। যে কারণে খাবারের ভিটামিন ও পুষ্টিগুণ বজায় থাকে। মাটির পাত্রে রান্না হলে খাদ্যের ভেতরে যে তৈল বা পানি থাকে তার বাহিরে অতিরিক্ত তৈল বা পানির প্রয়োজন হয় না। যে কারণে কম তেলে রান্না হয়। তাতে খাবারের স্বাদ ও পুষ্টিগত মান বজায় থাকে এবং খাবারে ফ্যাট কমায়। মাটির পাত্র প্রচুর আর্দ্রতা প্রদান করে এবং রান্নার সময় বাষ্প নিঃসরণ হয়। মাটির এসব প্রাকৃতিক শক্তি মানবদেহের জন্য নিঃসন্দেহে উপকারী। মাটির পাত্র প্রাকৃতিকভাবে ক্ষারযুক্ত, যা অম্লতা বা এসিডিটির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে অম্লতা বা এসিডিটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। যখন এসিডিক বা অম্লিক খাবার যেমন দুধ, ডিম, মাংস এসব মাটির পাত্রে রান্না হয় তখন মাটির ক্ষার অম্ল/এসিডিটিকে প্রতিরোধ করে। সুতরাং মাটির পাত্রের পানি ও খাবার এসিডিটি নিবন্ধক হিসেবে কাজ করে এবং গ্যাসট্রোনোমিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়।

ইসলাম অনুসন্ধানে জানা যায়,পবিত্র হাদীছ শরীফের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে- হযরত আবূ হাযেম রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি সাহল ইবনে সাদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে শুনেছি। হযরত আবু উসাইদ সাঈদী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনার যুফাফের রাতে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দাওয়াত দিলেন। উনার আহলিয়া সেদিন উনাদের খাবার পরিবেশন করেন। উনার আহলিয়া বলেন, আপনারা কি জানেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য সেদিন আমি কি পরিবেশন করেছিলাম? রাতের বেলা আমি উনার জন্য টাটকা খেজুর একটি মাটির পাত্রে ভিজিয়ে রেখেছিলাম। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)।

মাটির পাত্রে রান্না করলেও বহুবিধ উপকারের জানান দেয় মানুষের জন্য। 

তেল সাশ্রয়: মাটির পাত্রে রান্নার আরেকটি ভালো দিক হল, এতে তেল কম লাগে। ধীর গতিতে রান্না ও তাপ নিরোধক হওয়ায় এটা খাবারের প্রাকৃতিক তেল ও আদ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। 

স্বাদ ও ঘ্রাণ: খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় রেখে স্বাদ ও গন্ধ অনুক্ষণ রাখে বা বাড়িয়ে দেয় মাটির পাত্র। যা অন্যান্য উপাদানের তৈজস দিয়ে সম্ভব নয়।

প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা পানি: কাদা-মাটিতে থাকে আণুবীক্ষণিক ছোট ছোট ছিদ্র। ফলে এই কাদা-মাটির তৈরি পাত্রে পানি রাখা হলে বাষ্পীভবন ঘটে। আর এই প্রক্রিয়ায় পানি ঠান্ডা থাকে।

স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী: মাটির পাত্র একধরণের ক্ষারীয় উপাদান দিয়ে তৈরি যা খাবারের অ্যাসিড প্রক্রিয়াজাতকরণে সাহায্য করে এবং হজমে সাহায্য করে, মাটির পাত্রে রান্না করা খাবারে লৌহ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সালফারের মাত্রা বেশি থাকে।

বিপাক বাড়ায়: প্লাস্টিকের পরিবর্তে মাটির গ্লাস বা পাত্রে পানি পান করা হলে তা টেস্টোস্টেরনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। মাটি প্রাকৃতিকভাবে পানি ঠান্ডা রাখে। ফলে তা শরীরের বিপাক তথা নতুন কোষ ও রাসায়নিক পদার্থ তৈরি ও শক্তি উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। 

সতর্কতাঃ-

চকচকে মাটির পাত্র ব্যবহার না করারই ভালো।

মাটির পাত্র চকচকে ভাব আনার জন্য এতে নানান রাসায়নিক উপাদান মেশানো হয়। যা তাপ প্রয়োগে বিষাক্ত ধোঁয়া তৈরি করে। এমনকি বিষাক্ত নয় এমন পদার্থকেও বিষাক্ত করে তুলতে পারে।     

আমাদের সাথে কথা হয়,জেলার বাজিতপুর উপজেলার  ষাটোর্ধ আতর আলী,হোসেনপুর উপজেলার কামরুল,আলেক।তাড়াইল উপজেলার কেরামত মিয়া,পাকুন্দিয়া উপজেলার হরিদাসসহ অনেকেই মাটির সানকিতে বা পাত্রে খাবার খাওয়ার তৃপ্ততা প্রকাশ করেন।তারা বলেন, বর্তমানে মানুষ মাটির পাত্রে খেলে হেয় দৃষ্টিতে দেখেন কিন্তু এটাযে কত উপকার তা জানে না।

জেলার ভৈরবের মাটির তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রিকারী দোকানদার মনমোহন বলেন,এখন মাটির তৈরি জিনিস পত্রের মধ্যে বিভিন্ন টোটকা বা কবিরাজিতে যা ব্যবহার্য্য সেগুলোই বিক্রি হয়,এ পেশায় লাভ নেই এখন।

জেলার বাজিতপুরের  এক স্কুলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রাসেল হক দিদার বলেন,

আমাদের দেশীয় মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং আমাদের মাটির তৈরি আসবাব কিম্বা বাসনকোসন ব্যবহারে মনোযোগী হওয়া উচিত।এতে স্বাস্থ্যের জন্যও মঙ্গল।

জেলার হোসেনপুর উপজেলার সিদলা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন বলেন,

আমরা ছোট বেলায় দেখতাম মাটির তৈরি জিনিস ব্যবহার হতো ব্যাপক  হারে দৈনন্দিন জীবনে বর্তমানে এটা বিলুপ্ত প্রায়,আগের মত মাটির পাত্র ব্যবহার করলে যেমন হত পরিবেশ বা স্বাস্থ্য সম্মত তেমনই বেঁচে থাকতো এ অঞ্চলের মৃৎশিল্প।

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker