আন্তর্জাতিকফুটবলবাণিজ্য

ফুটবল যেভাবে আর্জেন্টিনার সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করেছে

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রতি এক ধরণের আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে আর্জেন্টিনার গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে।

এর মূল কারণ বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা দলের প্রতি বাংলাদেশি সমর্থকদের ব্যাপক সমর্থন।

বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ম্যাচগুলোতে জয়, বিশেষ করে লিওনেল মেসির সব কটি গোলের পর ঢাকায় সমর্থকদের বিপুল উদযাপনের ভিডিও কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

তার সূত্র ধরে গত সপ্তাহ খানেক ধরে আর্জেন্টাইনদের মধ্যে বাংলাদেশের, বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতি সমর্থন জানাতে দেখা গেছে সামাজিক মাধ্যমে।

এরপরই আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো কাফিয়েরো একটি টুইট করে জানান বাংলাদেশের সাথে বুয়েনোস আইরেস নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে।

আর্জেন্টাইন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টুইটটি করেছিলেন ১০ই ডিসেম্বর, যেদিন বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে দিয়েছিল লিওনেল মেসির দল।

সতর্কবাণী: মিশন ৯০’র নয় এমন ওয়েবসাইটের কনটেন্টের জন্য মিশন ৯০ দায়ী না

আর্জেন্টিনার প্রতি বাংলাদেশের ভালোবাসা

এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রতিটি জয়ের পর বাংলাদেশি ভক্তদের উচ্ছ্বাস ইতিমধ্যে নজর কেড়েছে সারা দুনিয়ার ফুটবল প্রেমীদের। তা নজর এড়ায়নি আর্জেন্টিনারও। বাঙালীর ফুটবল প্রীতি বেশ পুরনো, সে মুগ্ধতা এবং ভালোবাসা শুরুতে মূলত লাতিন ফুটবলের দিকে ঝুঁকে ছিল। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী পেলে আর জিকোর নাম মাঠ ছাড়িয়ে এক সময় বাঙ্গালীর মুখে মুখে ফিরত। ভালোবেসে অনেকে নিজের সন্তানের নাম রেখেছিলেন জিকো।

কিন্তু ১৯৮৬ তে সে ভালোবাসা নতুন ঠিকানা পেল। বিশ্বকাপ জয়ের সাথে সাথে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ম্যারাডোনা যেন মূহুর্তে পরিণত হন বাংলাদেশি মানুষের নতুন ফুটবল ঈশ্বরে। সে ভালোবাসা এখনো অটুট। ম্যারাডোনার প্রতি ভালোবাসা আর আর্জেন্টিনাকে সমর্থন যেন সমার্থক হয়ে উঠে।

ম্যারাডোনাকে নিয়ে পরবর্তীতে যখন অনেক বিতর্ক হয়েছে, তা কোনভাবেই বাংলাদেশে তার জনপ্রিয়তাকে ম্লান করতে পারেনি। এখনো লিওনেল মেসির দলের প্রতি একইরকম সমর্থন আছে বাংলাদেশের ভক্তদের। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে মারামারির অনেক ইতিহাস আছে বাংলাদেশে। আর্জেন্টিনার সমর্থনে প্রতি বিশ্বকাপ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় মিছিল হয়, আর্জেন্টিনার হাজার হাজার পতাকা বিক্রি হয় দেশজুড়ে। আর্জেন্টিনার উত্তেজনাময় ম্যাচে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাও গণমাধ্যমে দেখা গেছে।

১৯৮৬র পর আর কখনো শিরোপা জেতেনি আর্জেন্টিনা, কোনবার হয়ত গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েছে। তাতে বাংলাদেশে বহু মানুষ বিষাদগ্রস্ত হয়েছেন।

আর্জেন্টাইন সমর্থকদের একাংশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বড় পর্দায় খেলা দেখছেন আর্জেন্টাইন সমর্থকদের একাংশ

ম্যারাডোনা কখনো বাংলাদেশে আসেননি, কিন্তু ২০১১ সালে লিওনেল মেসি এসেছিলেন বাংলাদেশে।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি ফুটবল ম্যাচে মেসির খেলা নিজ চোখে দেখতে বহুমূল্য টিকেট কেটে গিয়েছিলেন হাজারো মানুষ।

কিন্তু এই যে হাজার হাজার মাইল দূরের একটি দেশের বা সেদেশের জন্য বাংলাদেশের মানুষের এই ভালোবাসা, তা যেন ডিসেম্বর মাসের শুরুতেই প্রথম স্বীকৃতি পেল আর্জেন্টিনার কাছে।

এর কারণ হচ্ছে, ডিসেম্বরের প্রথমদিন পোল্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ গোলে আর্জেন্টিনার জয়ের পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মেসির গোল উদযাপনের ভিডিওটি ভাইরাল হয়।

আর্জেন্টিনার কাগজে ঢাকার সমর্থকদের নিয়ে প্রকাশিত খবর
আর্জেন্টিনার কাগজে ঢাকার সমর্থকদের নিয়ে প্রকাশিত খবর
 

টুইটে কী লিখেছিলেন সান্তিয়াগো কাফিয়েরো?

মি: কাফিয়েরো টুইটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সাথে একটি ছবি পোষ্ট করেছেন। সাথে লিখেছেন, বাংলাদেশে ১৯৭৮ সাল থেকে বন্ধ আর্জেন্টিনার দূতাবাস পুনরায় চালু করার কথা ভাবছে আর্জেন্টিনা।

বাংলাদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তোলা হাস্যোজ্জল ছবিটি সম্পর্কে লিখেছেন, পরমাণু অস্ত্রের অপসারণ সংক্রান্ত জাতিসংঘের চুক্তি পর্যালোচনা বিষয়ক সম্মেলনে আগস্ট মাসের ১০ তারিখে আবুল কালাম আব্দুল মোমেনের সাথে এক বৈঠকের পর তোলা ছবি।

টুইটারে মি: কাফিয়েরোর ওই পোষ্টটি আড়াই হাজারের বেশিবার রিটুইট করা হয়েছে। মন্তব্য করেছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ, যেখানে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে নানা প্রশ্ন করেছেন অনেকে।

এমন এক প্রশ্নের জবাবে মি: কাফিয়েরো লিখেছেন, ২০২১ সালে আর্জেন্টিনা থেকে ৮৭৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশে। যা বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার পণ্য রপ্তানির ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। এসব রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সয়াবিন তেল, ময়দা, ভুট্টা এবং গম উল্লেখযোগ্য।

নিজের টুইটার পোষ্টের নিচেই আরেক প্রশ্নের জবাবে মি: কাফিয়েরো লিখেছেন, দূতাবাস চালুর ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে চলতি বছরের এপ্রিলে। নতুন করে আবারো দূতাবাস খোলার ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রধানত বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চায় আর্জেন্টিনা।

দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, আর্জেন্টিনার রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বাজারকে বৈচিত্র্যময় করতে চায় দেশটি। বাংলাদেশের সরকার কী বলছে?

বার্তা সংস্থা মেরকো প্রেসের খবর
বার্তা সংস্থা মেরকো প্রেসের খবর
 

আর্জেন্টিনা ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ থেকে দূতাবাস গুটিয়ে নেয়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই সময় দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব জোরালো ছিল না। এই মূহুর্তে আর্জেন্টিনাতেও বাংলাদেশের কোন দূতাবাস নেই।

কর্মকর্তারা বলেছেন, ১৯৯২ সালে সরকারি কৃচ্ছতাসাধনের অংশ হিসেবে বুয়েনোস আইরেসসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় এক ডজন বৈদেশিক মিশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তবে নতুন করে আর্জেন্টিনার দূতাবাস খোলার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেছেন, “এটা অসাধারণ, কিভাবে স্পোর্টস দুটো দেশকে কাছাকাছি নিয়ে আসে।”

তিনি আরো জানিয়েছেন, নতুন করে বাংলাদেশে দূতাবাস খোলার আলোচনা শুরু হয়েছে কিছুদিন আগেই। কিন্তু আর্জেন্টাইন ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশি ভক্তদের সমর্থন দেখার পর বিষয়টি সামনে আসলো।

মি: আলম বলেছেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি, ভৌগলিক অবস্থান, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের ‘গ্রোয়িং ইমপরট্যান্স’ এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তার সাথে ফুটবল একটি বাড়তি উপাদান যোগ করেছে। এবং এটা খুবই আনন্দের যে তিনি (আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বিষয়টিকে এখন সামনে নিয়ে এসেছেন।”

ব্রাজিলে বাংলাদেশের দূতাবাস আছে, এতদিন পর্যন্ত সেখান থেকেই আর্জেন্টিনার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে আসা হচ্ছিল, বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী মি: আলম। আর্জেন্টিনা ঢাকায় দূতাবাস স্থাপন করলে সেটি হবে বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোন লাতিন দেশের দূতাবাস।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার এত সমর্থনের বিষয়টি সামনে আসার পর আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে থাকা দেড়শো জনের মত বাংলাদেশি স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছেন। সেখানকার টেলিভিশন চ্যানেলে এখন বাঙালি খাবার, বিশেষ করে বিরিয়ানি রান্নার রেসিপি দেখানো হয়েছে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে।

আর্জেন্টিনার গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ

মেসির দলের প্রতি ১৭ হাজার মাইল দূরের একটি দেশের সমর্থকদের অকুণ্ঠ সমর্থন, মেসির গোলে আর্জেন্টাইনদের মতই বাঁধভাঙা উল্লাস, আর আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙিয়ে-মিছিল করে ব্যাপক আয়োজনের খবর সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে ঠিকই পৌঁছে গেছে দেশটিতে। ইতিমধ্যে কাতারে বিশ্বকাপের এক প্রাক ম্যাচ সংবাদ সম্মেলনে ‘সমর্থনের জন্য’ বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কাকোনি।

এছাড়া আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ধন্যবাদ জানানো হয়েছে বাংলাদেশকে। অন্যদিকে, সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সমর্থনে ‘ফ্যানস আর্হেন্তিনোস দে লা সিলেকসিয়ন দে ক্রিকেট দে বাংলাদেশ’ নামে খোলা হয়েছে একটি গ্রুপ, বাংলায় যার মানে, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আর্জেন্টাইন সমর্থক’। গ্রুপ খুলেছেন ড্যান লান্ডে নামক একজন আর্জেন্টাইন, তবে গ্রুপটিতে এখন আর্জেন্টাইনদের পাশাপাশি অনেক বাংলাদেশিও রয়েছেন। এর বাইরে আর্জেন্টিনার স্থানীয় সংবাদপত্রেও গত কয়েকদিন যাবত বাংলাদেশি ফুটবল ভক্তদের নিয়ে লেখা হয়েছে।

বুয়েনোস আইরেস টাইমস, বার্তা সংস্থা মেরকো প্রেস এবং এল ডেসটাপেসহ দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশকে নিয়ে নানা খবর। বাংলাদেশের ফুটবল ভক্তদের খবর, ক্রিকেটে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়ের খবর, দুই দেশের সম্পর্ক, নতুন বাণিজ্য সম্ভাবনা এবং পুনরায় দূতাবাস খোলার সম্ভাবনার খবর।

ফেসবুক গ্রুপ

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker