ইতিহাস ও ঐতিহ্যকিশোরগঞ্জ

কিশোরগঞ্জ জেলা ও উপজেলাগুলির নামকরণ

“উজান-ভাটির মিলিত ধারা, নদী-হাওর মাছে ভরা”
উপরিউক্ত চয়নটি কিশোরগঞ্জ জেলার ব্র‍্যান্ড নাম।

কিশোরগঞ্জ জেলা হাওর বাওরের জন্যে বেশ পরিচিত। নরসুন্দা নদী বিধৌত এই জেলা হাওর-বাওর ও সমতলভূমির বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতির একটি জনপদ। জেলার পূর্বে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মনবাড়ীয়া এবং পশ্চিমে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ জেলা, উত্তরে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ, দক্ষিণে নরসিংদী জেলা অবস্থিত।

আজ আমরা জানবো কিশোরগঞ্জ জেলা ও জেলার প্রতিটি উপজেলার নামকরণ সম্পর্কে।রবিউল আলম লুইপার বর্ণনায়: অনেকের মতে, উনিশ শতকের প্রথম দিকে কিশোরগঞ্জ নামকরণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিশোরগঞ্জ নামকরণ নিয়ে কয়েকটি মতবাদ প্রচলিত আছে। বত্রিশ প্রামাণিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের ষষ্ঠতম সন্তান নন্দকিশোর একটি হাট/বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। নন্দকিশোরের নামের শেষাংশ দিয়ে গঞ্জ টি কিশোরগঞ্জ নামে পরিচিতি লাভ করে।

জেলা গেজেটিয়ারে যদিও ঘটনাটি অন্যভাবে বিধৃত করা হয়েছে। কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের সাত সন্তানের একজনের নাম ব্রজকিশোর যার নামানুসারে এলাকাটির নাম কিশোরগঞ্জ হয়।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার নামকরণ জেলার নামকরণ অনুসারে।

জানা যায়, হোসেনপুর উপজেলার নামকরণ হয়,মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ এর আমলে তৎকালীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে পরগনার জনগণের অবস্থা দেখার জন্য এখানে আগমন করেন এবং দুলবাজার নামক এক জায়গায় তাবু গেঁড়ে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে এলাকাটির নাম সুলতানের নামানুসারে হোসেনপুর নাম ধারণ করে।১৯২২ খ্রিস্টাব্দে এখানে প্রথম থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। 

মজার তথ্য হলো, বাংলাবর্ণের ক্রমানুসারে বাংলাদেশের সর্বশেষ উপজেলার নাম হোসেনপুর (প্রথম উপজেলা যশোরের অভয়নগর)।

করিমগঞ্জ উপজেলা: মোঘল সম্রাটের নৌ প্রধান করিম খানের নামানুসারে অঞ্চলটির নাম করিমগঞ্জ রাখা হয়। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে এখানে প্রথম থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

পাকুন্দিয়া উপজেলা: এই উপজেলার মানচিত্র অনেকটা বৃত্তের মতো। পাকুন্দিয়া উপজেলা নামকরণ সম্পর্কে অনেক প্রবাদ প্রচলিত আছে।

সুকুমার সেনের মতে, পাকুর এবং দিয়া শব্দ দুটো নিয়ে পাকুরদিয়া অপভ্রংশে পাকুন্দিয়া নামকরণ করা হয়। পাকুর একটি গাছের নাম এবং দিয়া শব্দের অর্থ দুপাশে নদী বেষ্টিত ভূমি। একসময় নদী বেষ্টিত এই এলাকাটিতে প্রচুর পাকুর গাছ জন্মাতো। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

কটিয়াদী উপজেলা:কথিত আছে, কটিয়াদীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আড়িয়াল খাঁ নদীর উত্তর তীরে আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন কটি ফকির নামে এক লোক বাস করতেন। বহুলোক তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর নামানুসারে এলাকাটির নাম হয় কটিয়াদী।

অনেকেই মনে করেন, নীলকুঠি থেকে কটিয়াদী নামের উৎপত্তি। ইংরেজ আমলে আড়িয়াল খাঁ নদীর তীর সংলগ্ন এলাকায় অনেকগুলো নীলকুঠি এবং একটি হাট গড়ে উঠে। হাট টি নীলকুঠিহাট>কুঠি হাট অপভ্রংশে কটিয়াদি নাম ধারণ করে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে কটিয়াদী থানা উপজেলায় উন্নীত হয়।

বাজিতপুর উপজেলা: নামকরণ- মোঘল আমলের জনৈক রাজকর্মচারী বায়েজিদ খাঁ জ্ঞানী ও জনদরদী মানুষ ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পরিচিতি পায় এবং তাঁর নামানুসারে স্থানটি বায়েজিদপুর অপভ্রংশে বাজিতপুর নামকরণ করা হয়।১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

কুলিয়ারচর উপজেলা: একসময় মেঘনা ও কালী নদীতে জলদস্যুর প্রচন্ড প্রতাপ ছিল। মোঘল সম্রাট জলদস্যু দমন করার জন্য কুলি খাঁ নামে একজন সুবেদারের অধীনে একদল সেনা পাঠান। কুলি খাঁর নেতৃত্বে জলদস্যুতা বন্ধ হয় এবং এলাকায় শিক্ষার প্রসার ঘটে।

সুবেদার কুলি খাঁর নামে চরটির নাম হয় কুলিখাঁর চর অপভ্রংশে কুলিয়ার চর। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভৈরব উপজেলা: প্রাচীন বিটঘর (বর্তমান নবীনগর) তালুকদার ভৈরব রায় নৌবিহারের সময় মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত বিস্তীর্ণ সবুজ চরাঞ্চল দেখে মুগ্ধ হোন।

ভাগলপুরের জমিদার দেওয়ান আহমেদ রেজা এর অনুমতিতে ভৈরব রায় পরিত্যক্ত এ চরাঞ্চলে আবাদ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং নতুন প্রজা এনে চাষাবাদ শুরু করেন। সে থেকে অঞ্চলটি ভৈরব নামে পরিচিতি পায়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

নিকলী উপজেলা:এককালে এইজায়গায় প্রচুর নিমগাছ ছিলো। স্থানীয় কবিরাজগণ নিমের কলি থেকে ঔষধ বানাতো। অন্যান্য এলাকা থেকেও নিমের কলি নেয়ার জন্য লোকজন এই এলাকায় আসতো। কেউ কেউ মনে করেন, নিম গাছের কলি হতে নিমকলি অপভ্রংশে নিকলী নামকরণ করা হয়।

আবার অনেকের মতে, এখানকার জমিদার নিখিলচন্দ্রের নামানুসারে নিকলীর নামকরণ করা হয়। ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

অষ্টগ্রাম উপজেলা: অষ্টগ্রাম নামকরণে অনেকগুলো প্রবাদ প্রচলিত আছে। প্রবাদমতে, বল্লাল সেনের বিরুদ্ধে আট অধিসামন্ত বিদ্রোহ করে যাদের বাস ছিল এই এলাকায়, তাই এলাকাটির নাম অষ্টগ্রাম।

অনেকের মতে, আটটি পৃথক গ্রামকে যুক্ত করে এ জনপদ গঠিত হয় বলে এর নাম অষ্টগ্রাম।

আবার অনেকেই মনে করেন, হযরত শাহজালাল (রঃ) এর সাথে আগত আটজন আওলিয়ার সম্মানার্থে এলাকাটি আটগাঁও অপভ্রংশে অষ্টগ্রাম নামকরণ করা হয়।১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। 

ইটনা উপজেলা: ইটনা উপজেলার নামকরণ নিয়ে মজার প্রবাদ প্রচলিত আছে। জমির জরিপ চলাকালে কর্মচারীরা জরিপের ইতি ঘোষণা করার পরেও দেখা গেলো এলাকাটি আরো বড়, তাই জরিপের ইতি না। এই ইতিনা অপভ্রংশে ইটনা নামে পরিচিত হয়।

তবে অনেকেই এই কাহিনীকে নিছক প্রবাদ মনে করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

মিঠামইন উপজেলা: এলাকাটি একসময় খগড়া বনে পূর্ণ ছিল। খগড়া টিপলে মিঠা রস বের হতো। জনশ্রুতি, মন ভরানো এ মিঠা খগড়া বনের কারণে এলাকাটির নাম হয় মিঠামন অপভ্রংশে মিঠামইন।

আবার অনেকের মতে, জলাভূমির গভীর পানিতে মইন নামে এক প্রজাতির ধান জন্মাতো, যার চাল অনেক মিষ্টি ছিল। স্থানীয় ভাষায় মিষ্টিকে মিঠা বলার কারণে ধানের নামে এলাকাটির নাম হয় মিঠামইন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

তাড়াইল উপজেলা: তাড়াইল>তারাইল শব্দের অর্থ তারা সুন্দরীর আইল বা তারা সুন্দরীর ভূখন্ড। এই এলাকাটি জমিদার মহিম রায় তাঁর মা তারা সুন্দরীর নামে সেবা ও ধর্মকর্মে ব্যয় করার জন্য দান করেন। তাই এলাকাটি তারাইল>তাড়াইল নামে পরিচিতি পায়।১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

অধ্যাপক আশরাফ আহমেদ বলেন,কিশোরগঞ্জ ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি জেলা। জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জের প্রতিষ্ঠাকাল ১ ফব্রুয়ারী ১৯৮৪। তার আগে বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি মহকুমা ছিল। মহকুমা হিসাবে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে।

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker