জাতীয়

দর্শককে ঠকায় না বলেই ইত্যাদি আলাদা, অনবদ্য

এখন কন্টেন্টের যুগ। অথচ ইত্যাদি যখন শুরু হয়েছিল তখন ঘরে মাত্র একটি টেলিভিশন ছিল, বিটিভি। তখনও কেউ কেউ বলতেন, একটাই টেলিভিশন, বেশিদিন জনপ্রিয়তা টিকবে না। অথচ ইত্যাদির জন্য আমি আমরা দেখেছি অনুষ্ঠান শুরুর অন্তত ১০ মিনিট আগে টিভির সামনে সিনেমা শুরুর মতো করে বসে আছেন দর্শকরা! এরপর স্যাটেলাইট যুগ এলো। গুটিকতক ঈর্ষাকাতর নিন্দুক এবারও ভবিষ্যতবাণী করলেন, শেষ! ইত্যাদি এবার পড়ে যাবে! ঐ বিটিভির ট্রান্সমিশন এখন বেশি তো তাই! কতদিন আর মান ধরে রাখবেন তিনি। সম্ভব না।

ইত্যাদি পড়েনি, বরং সময়ের সাথে সাথে এর গুণগত মান বেড়েছে। বেড়েছে নান্দনিকতা। আর প্রযুক্তির সময়োপযোগী সংযোজন। দর্শককে না ঠকিয়ে এর রসদ জোগানোটা কঠিন এক অধ্যাবশায়ের কাজ। ইত্যাদি তা করেছে।

এখন মিডিয়ার বাহুল্যের যুগ। হাতে হাতে গণমাধ্যম। দর্শক চোখের বিরাম নেই। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারাবিশ্বের কন্টেন্ট নিয়ে এখন আমরা নিজেদের কন্টেন্টকে বিচার করি। যথারীতি কেউ কেউ বলেছিলেন, ইত্যাদি কী টিকবে? অথচ ইত্যাদি গত কয়েক বছর ধরে ডিজিটাল প্লাটফর্মে পোস্ট হলেই তা ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে ১ নম্বরে থাকে। ইত্যাদির প্রাণপুরুষ দেশবরেণ্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেতকে এর রহস্যের কথা জানতে চাইলে বলেন, ‘দর্শকের সাথে আমি সত্য থাকি। দর্শকদের ভালোবাসাই আমার শক্তি।’ সত্যিই তাই। তবে ভাবনার প্রকার ও প্রকাশ থাকে তার। ঈদ ইত্যাদির ১ ঘণ্টা ১২ মিনিটে ২২টি কন্টেন্ট দেখিয়েছেন নির্মাতা। এই পুরো সময়টাতে একবারের জন্যও মনে হয়নি যে, অনুষ্ঠানে খানিক বিরতির প্রয়োজন। এটিই একজন নির্মাতার স্বার্থকতা।

শুরুতে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গানটির নতুন সংগীতায়োজন ও চিত্রায়ণে অনবদ্য পরিবেশনা দি‌েই শুরু হলো। ইত্যাদি দীর্ঘদিন যাবত্ ভিন্ন ভিন্ন কম্পোজিশনে, ভিন্ন ভিন্ন কোরিওগ্রাফিতে এই গানটির পরিবেশনা করে আসছে। এই কালজয়ী গানের বড় আর্কাইভ হলো ইত্যাদি। তবে এবারের বাড়তি যোগ ছিল এই গানের অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন করোনাযুদ্ধে অংশ নেওয়া ২ শতাধিক করোনাযোদ্ধা। দারুণ এই আইডিয়ার জন্য আলাদা ধন্যবাদ পেতেই পারেন হানিফ সংকেত। আকর্ষণীয় স্কিডটি ছিল ভুঁইফোঁড় ইউটিউবারদের অত্যাচারে একে অপরকে বয়কট নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব। পুরো সেগমেন্টটি এতটাই বাস্তবতার সাথে মিল, যা সাম্প্রতিক সময়ের চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির কোন্দলকে মনে করিয়ে দিলো।

ঈদ বাজারে দুনী‌র্তিবাজের চরিত্রে অভিনেতা পলাশের অভিনয় নজরকাড়ে। গানে গানে ঈদের একাল সেকাল পর্বে তারিন-ফেরদৌস ছিল ইত্যাদির নিয়মিত প্যাটার্নেই। তবে দারুণ নজর কেড়েছে এবারের দর্শকপর্ব। অপূর্ব-পূর্ণিমার মতো জনপ্রিয় তারকাদের অভিনয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে এতটা সাবলীল অভিনয় করেছেন অতিথি দর্শকরা, তা মুগ্ধ করেছে দর্শকচোখ।

এবারের ইত্যাদির দুর্দান্ত স্কিড ছিল মোবাইলে পাত্র দেখার বিষয়টি। অতি লোভে তাঁতী নষ্ট এই মোরাল স্টোরিটা এত সুন্দর আর হিউমার দিয়ে বুঝিয়েছেন, যা সত্যিই অনবদ্য। ইত্যাদির দীর্ঘ কয়েক পর্বে আমরা গ্রিস এর নানা তথ্যবহুল ভ্রমণচিত্র দেখছিলাম। তবে সেরা সেগমেন্টটি হয়তো নির্মাতা ঈদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলেন। দারুণ সাবলীল অভিনয় আর স্ক্রিপ্টের রশদ মনে করিয়ে দেয়, এই কারণেই ইত্যাদি আলাদা। মেধাদীপ্ত রসবোধের ভেতর দিয়ে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরার এই আয়োজন আর কোথাও নেই। এছাড়াও ভীষণ সময়োপযোগী পর্ব ছিল মামা-ভাগ্নে এপিসোডে বর্তমান সময়ে মানহীন বাংলা গান যে হারে ভাইরাল হচ্ছে, তা তুলে ধরার বিষয়টা। আমাদের যে রুচির স্খলন হয়েছে তা এই অনুষ্ঠান যেখানে তুলে ধরে। একইভাবে হাসপাতালে নেতার আগমনে হাস্যরসের সাথে তীব্র ব্যঙ্গ ছিল। অনেকদিন পর শিবলী-নিপার পরিবেশনা ছিল অনবদ্য এক সংযোজন। শুধু এই একটি নৃত্যনাট্য দিয়েই অনেকে একটি গোটা অনুষ্ঠান করে ফেলতে পারেন। যথারীতি এই বরেণ্য জুটি তাদের নিজেদের স্বাক্ষর রাখলেন। সঙ্গে গুণী অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান, আবুল হায়াত, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় মন্ত্রমুগ্ধতা এনেছে। গানে সম্প্রতি দারুণ এক জুটিতে পরিণত হয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওন। তাদের কণ্ঠে এবারের ইত্যাদির পরিবেশনা ছিল সাবলীল। সিয়াম-পূজার পরিবেশনা ছিল যথাযথ ঈদ সংযুক্তি।

শেষে দর্শক হিসেবে অপেক্ষায় ছিলাম বিদেশিদের অংশগ্রহণে নাটিকার। কারণ করোনার কারণে এই পর্ব মিস করেছি খুব। উপস্হাপক সেই কারণটিও ব্যাখ্যা করলেন দারুণভাবে। নাটিকাটি যথারীতি মেসেজ ধর্মী এবং দারুণ অভিনয়। কোনো কোনো বিদেশিনীর ফলস লুক চোখে পড়লেও সেগুলোও দেখতে দারুণ নির্মল লেগেছে। শেষে কোরাস ড্রান্স আর ঢাকার কোকিলে গানটিতে নৃত্য পরিবেশনা যেন সবটুকু মিলিয়ে মাখন হয়ে গেছে।

নানি-নাতি পর্বের একটি বিশেষ শব্দ দারুণ লাগলো। তা হলো-‘এখন তো অ্যাওয়ার্ডও হোম ডেলিভারি দেওয়া হয়।’ নির্মাতার সমাজ সচেতনতা ও বিভিন্ন অসঙ্গতিগুলো কতটা সূক্ষ্ম হতে পারে তা ঐ একটি শব্দে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এ কারণেই তিনি হানিফ সংকেত। কারণ সাম্প্রতিককালে অ্যাওয়ার্ড তারকার ঘরে পৌঁছে দিয়ে সাজানো নাটকীয়তায় তারকাদের উচ্ছ্বাস রেকর্ড করার মতো প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সেটিই নানি-নাতি পর্বে দারুণ সূক্ষ্মভাবে উপস্হাপন করলেন। অনুষ্ঠান রিভিউয়ে জোর করে সমালোচক চোখ হয়তো দুয়েকটা অনিচ্ছার ভুল তুলতেই পারবেন। কিন্তু সাবলীল এক দর্শকের চোখে এবারের ঈদ ইত্যাদি গত ৩৪ বছরের ইত্যাদির আর্কাইভের সেরা সংকলন করলে অন্যতম সেরা বলে বলে সংরক্ষিত থাকা উচিত। দর্শক হিসেবে কৃতজ্ঞতা ইত্যাদিও প্রতি। ধন্যবাদ হানিফ সংকেত।

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker