সাহিত্য

বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী: হৃদয়বিদারক জীবন কাহিনী

চন্দ্রাবতী ষোড়শ শতাব্দীর কবি এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি৷ এই বিদুষী নারী অন্যান্য কাব্য ছাড়াও পিতার আদেশে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন।

কিশোরগঞ্জের কন্যা কবি চন্দ্রাবতী বাংলার আদি নারী কবি।তার পিতা মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা বংশীদাস ভট্টাচার্য এবং মাতার নাম সুলোচনা বা অঞ্জনা৷ দীনেশচন্দ্র সেনের মতে তিনি আনুমানিক ১৫৫০ সালে জন্মেছিলেন। তার জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ার বা পাটোয়ারী গ্রামে৷ জীবনকাল ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ। স্বরচিত রামায়ণের ভূমিকায় চন্দ্রাবতী আত্মপরিচয় দিয়েছেন।

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র অমর প্রেমগাথা মলুয়া, দস্যু কেনারাম, রামায়ণ ও অসংখ্য লোকগীতির রচয়িতা হিসেবে চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে মাইজখাপন ইউনিয়নের অন্তর্গত ফুলেশ্বরী নদীতীরবর্তী গ্রামে ষোড়শ শতকে (১৫৫০ খ্রি.) কবির জন্ম হয়। চন্দ্রাবতীর জীবনকাহিনী হৃদয়বিদারক এবং পরিণতি বিয়োগান্তক।

সাংবাদিক ও আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য সন্ধানী লেখক মু আ লতিফের বর্ণনায়,
পিতার টোলে পড়ালেখার সময় তিনি বাল্যকালেই সহপাঠী একই গ্রামের জয়ানন্দের প্রেমে পড়েন। বংশীদাস কন্যার মনোভাব জেনে জয়ানন্দের কাছেই তাকে বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেন।

উভয় পক্ষের সম্মতিতে বিয়ের তারিখও নির্ধারিত হয়। ঠিক তখনই আসে দুঃসংবাদ- জয়ানন্দ পার্শ্ববর্তী গ্রামের কমলা নামের এক মুসলিম নারীর প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে তাকে বিয়ে করেছেন।

চন্দ্রাবতীর বাল্যের প্রিয়জনকে চিরসাথী করে পাওয়ার আনন্দ-আকাঙ্ক্ষা নিমিষে চুরমার হয়ে যায় এবং তাঁর জীবন বিষাদে ছেয়ে যায়।

বংশীদাস বিষাদগ্রস্ত কন্যার মনে শান্তি ফেরাতে তাকে অন্যত্র পাত্রস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

এ অবস্থায় চন্দ্রাবতী পিতার কাছে দুটি বর প্রার্থনা করেন। একটি চিরকুমারিত্ব বরণ ও অন্যটি নিজ গৃহে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে অবশিষ্ট জীবন শিবের পূজায় অতিবাহিত করা।

নিরুপায় হয়ে বংশীদাস কন্যার প্রার্থনা পূরণ করেন এবং ফুলেশ্বরী নদীতীরে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে কন্যাকে শিবের আরাধনা ও কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করার সুযোগ করে দেন। চন্দ্রাবতী পিতার নির্দেশনা অনুযায়ী যোগিনী সেজে সকাল-সন্ধ্যা শিবপূজা ও রামায়ণ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।

কিন্তু নিয়তির নিয়ম কে খণ্ডাবে? তাই ঘটলো জীবনের শেষ অঘটন। ভেস্তে গেল কবির রামায়ণ রচনা। সংঘটিত হলো এক বিয়োগান্তক নাটক।

প্রতিদিনের মতো চন্দ্রাবতী মন্দিরে বসে রামায়ণ লিখছিলেন। এ সময় অনুশোচনায় অনুতপ্ত জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে আসে। কিন্তু চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেন।

শত অনুনয়েও তাঁর মন জয় করতে না পেরে জয়ানন্দ মনের দুঃখে শিবমন্দির গাত্রে শেষ বিদায়সূচক কয়েকটি কবিতার চরণ লিখে পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। চরণগুলি হলো:

“‘শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৌবনকালের সাথী
অপরাধ ক্ষমা করো তুমি চন্দ্রাবতী।
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।’”

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর চন্দ্রাবতী মন্দির থেকে বের হয়ে জয়ানন্দের লেখা কবিতার কয়টি চরণ দেখে পবিত্র মন্দিরগাত্র থেকে এর চিহ্ন মুছে ফেলতে পানি আনতে নদীর ঘাটে যান।

কিন্তু সেখানে টোলের সহপাঠী, বাল্য বয়সের খেলার সাথী জয়ানন্দের মৃতদেহ নদীতে ভাসতে দেখে তাঁর মনে ভাবান্তর ও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তীব্র অনুশোচনায় এক পর্যায়ে চন্দ্রাবতী ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেন।

চন্দ্রাবতীর জীবনাবসানের ফলে রামায়ণ রচনার কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। সেই অসমাপ্ত রামায়ণ এখনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথিশালায় সংরক্ষিত অবস্থায় বাংলার আদি নারী কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতি বহন করছে।

চন্দ্রাবতীর রামায়ণ রচনার অভিনবত্ব তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। তিনি রামায়ণে সীতাকে একজন বীর নারী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এতে রামের চেয়ে সীতাকে প্রাধান্য দিয়ে মূল চরিত্রে পরিণত করা হয়েছে। সীতা চরিত্রের এই নব-রীতি ও নির্মাণে আমরা আধুনিক ভাবনার প্রকাশ দেখি। এর মধ্য দিয়ে চন্দ্রাবতী নিজেকে একজন নারীবাদী হিসেবেই তুলে ধরেছেন।

চন্দ্রাবতী তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা এবং জীবনদর্শনের সম্মিলন ঘটিয়ে এক নতুন ‘রামায়ণ’ রচনা করেছেন। বর্তমানকালের গবেষকরা একে ‘সীতায়ণ’ নামে আখ্যায়িত করেছেন।

বাংলা সাহিত্যের আদি নারী কবি কিশোরগঞ্জের কন্যা চন্দ্রাবতীর পরিচয় পাই আমরা কেদারনাথ মজুমদারের ‘সৌরভ’ সাহিত্যপত্রে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দের মাধ্যমে।

‘মহিলা কবি চন্দ্রাবতী’ শিরোনামে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত সৌরভ মাসিক পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হলে সেটি ড. দীনেশচন্দ্র সেনের দৃষ্টিতে পড়ে। এর পর তাঁরই আগ্রহে তিনি ও চন্দ্রকুমার দে মিলে লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা চন্দ্রাবতীর লেখা বহু গাথা উদ্ধার করেন।

একটি পালায় তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন:

‘ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়॥
ভট্টাচার্য ঘরে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী।
বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনি॥
ঘট বসাইয়া সদা পূজে মনসায়।
কোপ করি সেই হেতু লক্ষ্মী ছাড়ি যায়॥
দ্বিজবংশী বড় হৈল মনসার বরে।
ভাসান গাইয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে॥

চন্দ্রাবতী নেই। কিন্তু কিশোরগঞ্জে জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর প্রেমের কাহিনী এবং তাদের ট্র্যাজিক পরিণতি এখনো গানে গানে ও লোকজ নাটকে অভিনীত হয়। ফুলেশ্বরী নদীতীরে প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রাবতীর শিবমন্দিরটি এখন ঐতিহাসিকদের জন্য দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত।

‘কিশোরগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থে এ মন্দিরটির বিবরণে বলা হয়েছে, মন্দিরটি অষ্টকোণাকৃতির। উচ্চতা ১১ মিটার। আটটি কোনার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১.৭ মিটার। নিচের ধাপে একটি কক্ষ ও কক্ষে যাবার জন্য একটি দরজা রয়েছে। ভিতরে শিবপূজা অনুষ্ঠিত হয়।

নিচের সরল রেখায় নির্মিত অংশটি দুটি ধাপে নির্মিত। নিচের ধাপের চারদিকে প্রায়-অর্ধ বৃত্তাকার খিলানের সাহায্যে নির্মিত প্রশস্ত কুলঙ্গী রয়েছে। নিচের ধাপে কার্নিশ পর্যন্ত উচ্চতা ২.৭০ মিটার। কক্ষের ভিতরে সাতটি জানালাসদৃশ কুলঙ্গী রয়েছে যার প্রস্থ ৫২ সেন্টিমিটার এবং দৈর্ঘ্য ৯৯ সেমি। কিছু কারুকাজও আছে। কক্ষের ব্যাস ২.৩৫ মিটার। কার্নিশ বরাবর অনুচ্চ ছাদ রয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপটিও সরলরেখায় নির্মিত। এই পর্যায়েও অর্ধবৃত্তাকারের খিলানের সাহায্যে নির্মিত প্রশস্ত কুলঙ্গী রয়েছে। কুলঙ্গীর ভিতরে একদা পোড়ামাটির অসংখ্য চিত্রফলকের অলংকরণ ছিল যা আজ অবশিষ্ট নেই। দ্বিতীয় ধাপ থেকে এটি ক্রমশ সরু হয়ে সূক্ষ্মাগ্র চূড়ায় শেষ হয়েছে। চূড়ার শেষে প্রান্তদেশে খাঁজকাটা কারুকাজ আছে এবং কলসাকৃতি চূড়ার শীর্ষদেশে আছে সরু ডাঁটার আকারে নির্মিত ‘ফাইনিয়েল’।

চন্দ্রাবতীর মন্দিরের কাছেই আরো একটি শিবমন্দির রয়েছে। এটিও অষ্টকোণাকৃতির। অনেকেই এটিকে দ্বিজবংশী দাসের মন্দির মনে করেন। এর নির্মাণশৈলী দেখে অনুমান করা হয় এটি সম্ভবত অষ্টাদশ অথবা ঊনবিংশ শতকের প্রথম পাদে নির্মিত।

এর পাশেই রয়েছে একটি অট্টালিকা। এটি স্থানীয় জমিদার নীলকণ্ঠ রায়ের বাড়ি। আবার এও ধারণা করা হয় এ বাড়িটি দ্বিজবংশী দাসের। এ নিয়ে রয়েছে মতদ্বৈধতা।


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts to your email.

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker