ইতিহাস ও ঐতিহ্যকিশোরগঞ্জ

কিশোরগঞ্জে বিলুপ্ত প্রায় মহামূল্যবান ভেন্না গাছ

পড়ন্ত বিকেল সূর্য পশ্চিম দিগন্তে অস্তগামী, নিভো নিভো স্বর্ণালী রোদ্দুর, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে জিনারী ইউনিয়নের চরকাটিহারী গ্রামের ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী বা খালের দক্ষিণ দিকে গাঁয়ের বেরি বাঁধের একপাশে হঠাৎ দৃষ্টির খুব কাছাকাছি দৃশ্যমান হয় প্রায় বিলুপ্ত ঔষধি গুনীয় গাছ ভেন্না। মুহুর্তে বিভোর হয়ে গেলাম স্বপ্নের লোভে। মনে পড়ে গেল শৈশবের কথা। ফিরে গেলাম ছোট বেলায় স্বপ্নময় আবেগের সীমানায়। ছোট বেলায় বাড়ীর পাশে বাঁশের/সুপারি বাগানের পিছনে। বিরছার ক্ষেতে ঝোপের আড়ালে ভেন্না গাছ থেকে ভেন্না বিচি সংগ্রহ করে রাখতাম। ফেরিওয়ালা আসলে দৌড়ে গিয়ে ভেন্না বিচির বিনিময়ে তিলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া পেয়ে আনন্দে আত্ন হারা হয়ে যেতাম। কখনো কখনো কাছাকাছি বয়সের খেলার সহপাঠীদের সাথে নাড়ু, মোয়া, ছিনিয়ে নেওয়ায় ঝগড়া করতাম।

রিদপিন্ডটাকে হঠাৎ ঝাঁকিতে নাড়িয়ে দিল ভেন্না বিরহ! ভেবে ফেললাম হায়রে নিদারুণ প্রকৃতি তুমি কৃত্রিমতায় মজে, বিরহ বিয়োগে শ্বশ্মান করে দিচ্ছে বহু ছায়া সুন্দর ভেষজ।

আসল কথায় আসি- নিবিড় মনে সুধীর চোখে দেখলে বোধগম্য হওয়া যায়। ভেন্না, কেউ বলে ভেরেন্ডা,  রেঢ়ী বলেও আখ্যায়িত করে অনেকে। যা কিনা আগাছা হিসাবেই সুপরিচিত।

ভেন্না বহুবর্ষজীবি উদ্ভিদ। ভেন্না গাছ ১০-১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। প্রায় ডালপালাহীন গাছ, উপরের দিকে অল্পকটি ডাল হতে দেখা যায়। গাছের কাণ্ডের ভেরতটা ফাঁপা থাকে। কাণ্ডের বেড় ৫-৬ ইঞ্চি হতে পারে। কাণ্ডে ৫-৬ ইঞ্চি দূরে দূরে একটি করে গিঁট থাকে। প্রতিটা গিট থেকে বেরোয় একটা করে পাতা। কান্ড ধূসর প্রকৃতির এবং ফাঁপা হয়। ভেন্না গাছ দেখতে কিছুটা পেঁপে গাছের মত, হালকা-পলকা গাছ। পাতাও দেখতে অনেকটা ছোট পেঁপে পাতার মতই। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাতার উদ্ভিদের মধ্যে ভেন্না একটি। লম্বা বোঁটা বা ডাঁটা যুক্ত সবুজ এই পাতার ব্যস এক থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত হতে পারে। বোঁটা দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। বোঁটার ভেতরটাও পেঁপে ডাটার মতই ফাঁপা হয়। পাতার বাইরের কিনারে খাঁজকাটা খাঁজকাটা থাকে।

ভেন্নার আদি নিবাস সম্ভবত আফ্রিকা। এর ব্যাপক আবাদ হয় ভারত, মেক্সিকো ও ব্রাজিলে। বাংলাদেশে সর্বত্র জন্মে, গ্রামাঞ্চলে কেউ কেউ বসতভিটার আশেপাশে রোপণ করে, কিংবা বনে বাদাড়ে নিজে থেকেই জন্মে। মার্চ-এপ্রিল মাসে বীজ বপন করতে হয়। গাছে ফুল ও ফল হয় আগস্ট-সেপ্টেম্বরে।

সাধারণত বর্ষাকালে ভেন্নার চারা গজায়। প্রতি বছর হেমন্ত ও শীতকালে ভেন্নার ফুল-ফল হয়। ভেন্না গাছের মাথায় থোকা থোকা লালচে ফুল হয়। ফলও হয় থোকা থোকা, একেকটা প্রায় এক ইঞ্চির মত। সবুজ ফলের গায়ে নরম নরম কাঁটা থাকে। এ কাঁটা এতোটাই নরম যে, গায়ে ফোঁটে না। ফলের ভিতরে ৩ বা ৪টা কালো বাদামী ছোপের বীজ থাকে। ভেন্নার এই বীজ থেকেই তৈরি হয় ক্যাস্টর অয়েল।

বিশেষ তত্বমতে জানা যায়, ভেন্নার তেলের উপকারী গুণাবলী  অসংখ্য তার মধ্যে

১. কাচা ভেন্না সবজি হিসাবে খাওয়া যায় (পরিপক্ক বীজ এবং ফল খাওয়া উচিত নয়)

২. চুল পড়া রোধ করতে

৩. চুলকে ঘন করতে

৪. চোখের আইব্রো কে ঘন এবং কালো করতে

৫. ত্বক কে মোলায়েম করতে ব্যবহার করতে হয় ভেন্নার তেল

৬. স্কিন থেকে ময়লা দূর করতে

৭. ডার্ক সার্কেল থেকে মুক্তি পেতে ব্যবহার করুন ভেন্নার তেল

৮. শুস্ক ত্বক কে মোলায়েম করে

৯. ত্বকের বর্নবিলোপ দূর করে

১০. বলিরেখা দূর করে

১১. ত্বকের কালো দাগ দূর করে

১২. মাথার স্ক্যাল্প কে সুস্থতা দান করে

১৩. চুলের কন্ডিশন করতে

১৪. গোলাকৃমির চিকিৎসার জন্যে এই তেল উপকারী

১৫. কাটা ঘায়ে জীবানুমুক্ত করতে

১৬. ব্যাক পেইন কে দূর করতে

১৭. শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কে শক্তিশালী করে

১৮. জয়েন্ট পেইন কে ধ্বংস করে

১৯. ফুড এডিটিভস হিসাবে ব্যবহৃত হয়

২০. ফুডের ফ্লেভার করতে ভেন্নার তেলের বিভিন্ন রেসিপি আছে

২১. ফাংগাস প্রতিরোধে করে ফলে মোল্ড প্রতিরোধ করে

২২. বীজ সংরক্ষণ করতে এর জুড়ি মেলা ভার

২৩. ফুড প্যাকেজিং করতে ভেন্নার তেল ব্যবহৃত হয়

২৪. আধুনিক ফার্মা কোম্পানিতে বিভিন্ন মেডিসিন বানাতে ভেন্নার তেল একটি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

যেমন – এন্টি ফাংগাল(মাইকোনাজোল)

– আলসার চিকিৎসায়

– ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে

– প্যাক্লিক্যাক উপাদান হিসেবে

– আরও অন্যান মেডিসিনের প্রিকারসর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

২৫. ঠোঁট ফাঁটা রোধ করতে

২৬. পা ফাঁটা রোধা করে

২৭. নখের অসুস্থতায় ব্যবহৃত হয় ভেন্নার তেল

২৮. বায়োফুয়েল হিসাবে ভেন্নার তেল সাশ্রয়ী।

২৯. এয়ারক্র্যাফট এর জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

৩০. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রোটারি মেশিন এর ইঞ্জিন ওয়েল হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল ভেন্নার তেল

৩১. লুব্রিকেশন এর কাজে উত্তম লুব্রিকেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয়

৩২. খাদ্য সামগ্রী কোটিং করতে ব্যবহৃত হয় ভেন্নার তেল

৩৩. ইটলীর মুসোলিনি শত্রুদের শাস্তি দিতে এর তেল ব্যবহার করেছিলেন

৩৪. এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসকেরা এই তেল খাইয়ে এদেশের মানুষ দের শাস্তি দিত

৩৫. ক্যাস্টর ওয়াক্স বানাতে ক্যাস্টর ওয়েল

৩৬. এই তেলে রয়েছে ভিটামিন ই, মিনারেল, প্রোটিন এবং অন্যান্য পুস্টি উপাদান

৩৭. আইল্যাশ ঘন করতে এই তেল ব্যবহৃত হয়

৩৮. গর্ভাবস্থার দাগ দূর করতে ব্যবহৃত হয়

৩৯. চোখের ছানি পড়া দূর করতে ব্যবহৃত হয়

৪০. ফোড়া সারাতে এই তেল দারুন কার্যকরী

৪১. গায়ের আচিল দূর করতে এই তেলের অসাধারন গুন রয়েছে

৪২. নাকডাক বন্ধের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় এই তেল

৪৩. পেট ফাপা দূর করতে এই তেল বেশ উপকারী

৪৪. তারুণ্য ফিরে পেতে ক্যাস্টর অয়েল দারুন

৪৫. হেপাটাইটিস এর চিকিৎসা য় ব্যবহৃত হয়

৪৬. কন্ঠের কর্কশ ভাব দূর করতে এই তেল ব্যবহৃত হয়।

৪৭. এলার্জির চিকিৎসার উপাদান হিসাবে ব্যবহার হয়

৪৮. ত্বকে পুষ্টি যোগাতে এই তেলের তুলন নেই

৪৯. মালিশের কাজে ব্যবহৃত হয়

৫০. ভেন্নার খইল অর্গানিক সার হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

( ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত কে প্রাধান্য দিতে হবে এবং ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করতে হবে।)

যদিও বা  সময়ের কষাঘাতে ভেন্নার চাষ মানুষের মন প্রকোষ্ঠে ভিত্তিহীন, হয়না ব্যবসায়িক উদ্যেশ্যে ভেন্না চাষ।সময় যত গত হচ্ছে বসন্ধরার নির্মমতায় ক্রমান্বয়ে মরণোত্তর চির বিদায় জানাচ্ছে মৃত্তিকার পাজর থেকে ভেন্নাকে।

কৃষি গবেষকদের মস্তিস্কের সুপ্রসন্নতায় হুদিস মিলে, যেকোন অনুর্বর মাটিতে ভেন্না চাষ হতে পারে। তবে মাটির পিএইচ ৫.৫-৬.০ হলে ভাল। বেলে দো আশ মাটিতে ভেন্না ভাল হয়,কৃষি তত্বমতে।বর্ষার আগে জুন মাসে / বছরের যে কোন সময়। সেচ এবং বৃষ্টি নির্ভর পদ্ধতি চাষ করা যায়। আগাছা পরিষ্কার করে ৩-৪ চাষ দিয়ে জমি প্রস্তুত করে নিতে হবে।বীজের হার এবং বপন:  ১০-১২/হেঃ, চারা থেকে চারার দূরত্ব ৪০-৬০ সেঃ মিঃ এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০-১২০ সেমি।তেমন সার লাগে না তবে ভাল ফলনের জন্যে N: P: K অনুপাত হবে ৪০কেজি : ৪০কেজি : ২০কেজি হেক্টর প্রতি। ইউরিয়া অর্ধেক শেষ চাষের সময় বাকি সার এক সাথে আর বাকি অর্ধেক ইউরিয়া চারা গজানোর ৩০ -৪০ দিন পর দিতে হবে। অধিক ফলনের জন্যে ২০কেজি/হেঃ সালফার ব্যবহার করলে ভাল হয়।

১৪০-১৭০ দিনের মধ্যে ফল পাকতে শুরু করে এবং ২-১ টি ফল পেকে শুকিয়ে গেলেই সংগ্রহ করতে হবে এবং মাড়াই করে সংরক্ষণ করতে হবে। বৃষ্টি নির্ভর ৩৫০-৫০০ কেজি/হেঃ এবং সেচ নির্ভর পদ্ধতিতে ৭০০-৮০০ কেজি ক্যাস্টর বীজ পাওয়া যায়। আন্তঃফসল হিসেবে বাদাম, ছোলা ইত্যাদি চাষ করে বাড়তি আয় সম্ভব হয়।

ভেন্নার গাছ জ্বালানি হিসেবে, বাড়ির আঙ্গিনার বেড়া ও সবজির মাচায় ব্যবহার করা যায়। নদী তীরবর্তী এলাকার মাটি ভেন্নার জন্য খুবই উপযোগী। এ অঞ্চলে ভেন্না চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ অঞ্চল থেকে ভেন্না হারিয়ে যেতে বসেছে।

ভেন্না বিনা চাষেই বর্ষাকালে গজায় এবং হেমন্ত ও শীতকালে ফুল ও ফল ধরা শুরু করে। অনুকূল পরিবেশ পেলে সারা বছরই ফল ধরে। বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বোম্বাই ও স্থানীয় জাতের ভেন্নাই আমাদের দেশে বেশি দেখা যেতো।

গাছের বয়স দুই থেকে তিন মাস হলে শাখায় শাখায় ফুলের কাঁদি হয়। প্রতিটি কাঁদিতে দেড় থেকে দুই শতাধিক পর্যন্ত ফল ধরে। প্রত্যেক ফলে তিন-চারটি বীজ দানা হয়। কিছু দিন পর কাঁদিগুলো পাক ধরলে হাল্কা কালচে বর্ণের হয়। তখন গাছ থেকে কাঁদিসহ ফল ছাড়িয়ে নিয়ে রোদে শুকিয়ে বীজ সংগ্রহ করা হয়।

আগের দিনে বেপারীরা ধামায় করে গ্রাম থেকে ভেন্না ওজনে কিনে নিয়ে যেত। এখন তাদেরও দেখা মেলে না।কৃষি কাজের প্রয়োজনে পুকুর বা ডোবা-নালার নোংরা পচা পানিতে নামার আগে এ তেল শরীরে মেখে নিলে শরীর চুলকায় না এবং জোঁক কামড়ায় না। এর কাঁচা বীজ কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা সমাধানে বিশেষ কার্যকর। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগলেও তেল গরম করে বুকে মালিশ করলে আরাম পাওয়া যায়।

খাদ্যমান, ভেষজ গুণ, সহজ চাষ, খরচ কমসহ নানা দিক বিবেচনা করে কৃষকেরা পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভেন্না এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল হতে পারে।

কালের পরিক্রমায় হারাতে বসেছে ভেন্নার মত মূল্যবান ঔষধি ও প্রয়োজনীয় গাছ, কিশোরগঞ্জের কোথাও এখন আর তেমন ভাবে দেখা যায়না। ভেন্না গাছ জলাশয়ের তীরবর্তী স্থানে মাঝে মাঝে চোঁখে পড়ে ঝোপের ভেতর দু একটা গাছ। অতি মূল্যবান গাছের চাষাবাদের সন্ধান মিলেনি  কিশোরগঞ্জের কোথাও।

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker