কালিহাতী

কালিহাতীর দুই ইউপি নির্বাচন সহিংসতায় রূপ নিয়েছে

আব্দুস সাত্তার, বিশেষ প্রতিনিধি

টাঙ্গাইলের কালিহাতীর উপজেলার বীরবাসিন্দা ও পারখী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আগামী সোমবার (১৭ জুলাই)। এ দুই ইউপি নির্বাচনে প্রচারণাকালে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটেছে। একাধিক সহিংস ঘটনার কারণে প্রার্থীদের অর্ধ শতাধিক কর্মী-সমর্থক আহত হয়েছেন। প্রার্থীদের অভিযোগ, স্থানীয় নির্বাচন কমিশন সহিংস ঘটনার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে পরবর্তী ঘটনা রোধ করা সম্ভব ছিল। সোমবার ভোট গ্রহণেও সহিংস ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে বলে তাদের দাবি।

জানা গেছে, ২০১১ সালে কালিহাতীর বীরবাসিন্দা ইউনিয়ন ভেঙে পারখী ও বীরবাসিন্দা নামে পৃথক দুইটি ইউনিয়ন করা হয়। ওই দুই ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন ৭ জন। বীরবাসিন্দা ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আব্দুল খালেক (নৌকা)। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সেলিম শিকদার (আনারস)। তিনি উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সদ্য সাময়িক বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি। আওয়ামীলীগের বিদ্র্রোহী প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান ছোহরা আলী (মোটরসাইকেল)। তিনি বীরবাসিন্দা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সদ্য সাময়িক বহিষ্কৃত সভাপতি। এ ইউনিয়নে একমাত্র নারী স্বতন্ত্র প্রার্থী মিতু আক্তার (চশমা)। পারখী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান তালুকদার তোতা (নৌকা)। তিনি কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি। এ ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যা লিয়াকত আলী তালুকদার (মোটরসাইকেল)। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের বহিষ্কৃ সহ-সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মোল্লা বেয়াই। এছাড়া কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী হয়েছেন আব্দুস সবুর শামীম (গামছা)।

এ নিবার্চনকে কেন্দ্র করে বীরবাসিন্দা ইউনিয়নে নৌকা ও মোটরসাইকেল প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা, মারামারি ও নির্বাচনী অফিস ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক কর্মী-সমর্থক। এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণ ও গণনা নিয়ে আবারও সংঘাতের আশঙ্কা করছেন প্রার্থীরা।

চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী ছোহরাব আলী জানান, তার নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক আরিফুর রহমান লিটনকে নৌকা প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছে। কস্তুরীপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আরিফুর রহমান লিটন এখন ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এছাড়াও নির্বাচনী অফিস ও গাড়ি ভাংচুর করে প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনী এলাকার প্রসিদ্ধ স্থানে স্থানীয় জনসাধারণের দাবির মুখে তিনি ৭টি অফিস দিয়েছিলেন। নৌকার প্রার্থী আব্দুল খালেকের কর্মী-সমর্থকরা ৭টি নির্বাচনী অফিসের মধ্যে ৬টি বিভিন্ন সময়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। শুধুমাত্র সিংনা গ্রামে তার নির্বাচনী অফিস রয়েছে। গত বুধবার (১২ জুলাই) সন্ধ্যায় কস্তুরীপাড়া জামে মসজিদের সামনে ও বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) দুপুরে রাজাফৈর বাজার এলাকায় তার কর্মী-সমর্থকদের উপর নৌকার প্রার্থীর লোকজন হামলা চালিয়ে অন্তত ১২ জনকে আহত করেছে। এর আগে ৬টি অফিস ভাঙতে গিয়ে তার অর্ধশত কর্মী-সমর্থককে আহত করা হয়েছে।

ছোহরাব আলী আরও জানান, তিনি নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। রিটার্নিং অফিসার অভিযোগের বিষয়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাকে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশ্বাস দিয়েছেন। ৬টি নির্বাচনী অফিস ভাংচুরের প্রথমটার বিষয়ে রিটার্নিং অফিসার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পরবর্তী ঘটনাগুলো রোধ করা সম্ভব হতো।

বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) দুপুরে এ দুই ইউনিয়নের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। ওই দিনই রাতে ইউনিয়নের সিংনায় সহিংস ঘটনায় কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক শরীফ আহমেদ রাজুসহ পাঁচ জনকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুত্বর আহত করা হয়। আহতরা হামলাকারীদের বর্তমান চেয়ারম্যান ছোহরাব আলীর লোকজন বলে দাবি করেন। বীরবাসিন্দা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থী ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক জানান, তার কর্মী-সমর্থকরা কোনো প্রার্থী বা তার কর্মী-সমর্থকদের উপর হামলা বা পাল্টা হামলা চালায়নি। কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী অফিসও ভাংচুর করা হয়নি। বর্তমান চেয়ারম্যান নির্বাচনী কৌশল হিসেবে অফিস ভাংচুরের অভিযোগ করছেন। বরং বৃহস্পতিবার নৌকার পক্ষে সিংনা গ্রামে ভোট চাইতে গেলে মোটরসাইকেলের কর্মী-সমর্থকরা হামলা করে কুপিয়ে তাদের পাঁচজন নেতাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে।

তিনি আরও জানান, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হবেন।

পারখী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান তোতা জানান, এ ইউনিয়নে নৌকার পক্ষে জনগণের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ইউনিয়নের প্রতিটি এলাকায় নৌকার কর্মী-সমর্থকরা ভোট প্রার্থণা করছেন। তবে আউলিয়াবাদ এলাকায় ভোট চাইতে গিয়ে তার কর্মীরা একাধিকবার মোটরসাইকেলের কর্মীদের বাঁধায় ভোট চাইতে পারেনি।

এ ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী মো: লিয়াকত আলী তালুকদার জানান, তার কর্মী-সমর্থকরা ভোট চাইতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নৌকার প্রার্থীর কর্মীদের বাঁধার সম্মুখিন হচ্ছে। ইউনিয়নের বর্গা, সরিষাআটা, ভিয়াইল, রৌহা প্রভৃতি এলাকায় তার কর্মীরা ভোট চাইতে যেতে পারছেনা। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণ হলে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হবেন।

কালিহাতী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোল্লা আজিজুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনায় রকিবুল ইসলাম সুমন বাদী হয়ে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ছোহরাব হোসেনকে প্রধান আসামি করে ৪৩ জনের নামে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হামলা চালানো হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই ঘটনায় হেলাল উদ্দীন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাহারুল ইসলাম তালুকদার জানান, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নির্বাচন করায় তিন চেয়ারম্যান প্রাার্থীকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন- বীরবাসিন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছোহরাব আলী, একই ইউনিয়নের উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সহ-সভাপতি সেলিম সিকদার ও পারখী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী তালুকদার।

তিনি আরও জানান, প্রতিটি নির্বাচনেই ছোটখাট ২-১টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে থাকে। বলা যায়- বাঙালি জাতি হিসেবে এটা একটি ট্রাডিশন। তবে ঘটনা যাই ঘটে থাকুক- প্রতিকারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্ক থাকেনা।

কালিহাতী উপজেলা নির্বাচন অফিসার ও ইউপি নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মিসবাহ উদ্দীন আহমেদ জানান, বীরবাসিন্দা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ জমা দিয়েছেন। সেগুলো তারা তদন্ত করছেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তারা সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা স্যার কালিহাতীতে মতবিনিময় সভা করেছেন। সেখানে পুলিশ প্রশাসন ও প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচনে কোন প্রকার সহিংসতার শঙ্কা নেই।

তিনি জানান, অভিযোগ পেয়ে তারা নিজেদের মতো করে তদন্ত করে প্রয়াজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন। যে ঘটনা ফৌজদারী কার্যবিধির আওতায় পরে সে বিষয়ে থানা পুলিশ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, বীরবাসিন্দা ইউনিয়নে মোট ভোটার ১৬ হাজার ৭০৫ এবং পারখী ইউনিয়নে ১৬ হাজার ৫৮৪ জন।

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker