জাতীয়

সারা দিন লাশ তুলে অসুস্থ, যা ঘটেছিল সেই রাতে

‘হঠাৎ ভীষণ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসলাম। রুমী-জামী ছুটে এলো এ ঘরে। কী ব্যাপার? দু-তিন রকমের শব্দ—ভারী বোমার বুম বুম আওয়াজ, মেশিনগানের ঠাঠাঠাঠা আওয়াজ, চি-ই-ই-ই করে আরেকটা শব্দ। আকাশে কী যেন জ্বলে জ্বলে উঠছে, তার আলোয় ঘরের ভেতর পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠছে। সবাই ছুটলাম ছাদে। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে মাঠ পেরিয়ে ইকবাল হল (পরে জহুরুল হক হল—বা.স.), মুহসীন হল, আরো কয়েকটা হল, ইউনিভার্সিটির কোয়াটার্সের কয়েকটা বিল্ডিং। বেশির ভাগ আওয়াজ সেই দিক থেকে আসছে, সেই সঙ্গে বহু কণ্ঠের আর্তনাদ, চিৎকার।’

এই বর্ণনা গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রুমির মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের। তিনি তাঁর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঢাকার ঘটনাপঞ্জির অনন্য দলিল ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে ২৫ মার্চের ভয়াল সেই রাতের এই বর্ণনা দিয়েছেন। 

আরো পড়ুন: আজ রাত সাড়ে ১০টায় প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’

সেদিন মধ্যরাতের দিকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পিত নির্মম ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়াই ছিল যার লক্ষ্য। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু করে ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত গণহত্যা। ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞ ছিল এক জঘন্য গণহত্যার সূচনামাত্র। এ গণহত্যা চলতে থাকে পরবর্তী ৯ মাস ধরে।

আরো পড়ুন: খুলনায় আওয়ামী লীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা

২৫ মার্চের দিবাগত রাত এবং তার পরের কয়েকটি দিনে রাজধানী ঢাকা যে ধ্বংস আর লাশের শহরে পরিণত হয়েছিল, তার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা পাওয়া যায় তৎকালীন ঢাকা পৌরসভার ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে সুইপার কলোনির দুই ডোম চুন্নু ও ছোটনের বক্তব্য থেকে। কবি, সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’-এর অষ্টম খণ্ডে ১৯৭৪ সালের ৭ এপ্রিল দেওয়া চুন্নু ও ছোটন ডোমের বক্তব্য ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

চুন্নু ডোমের স্মৃতিচারণা

 ‘২৮ মার্চ সকালে আমাদের পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব আমাকে লাশ উঠাবার জন্য ডেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যান। সেখান থেকে আমাকে, বদলু ডোম, রঞ্জিত লাল বাহাদুর, গণেশ ডোম ও কানাইকে একটি ট্রাকে করে প্রথম শাঁখারীবাজারের কোর্টের প্রবেশপথের সম্মুখে নামিয়ে দেয়। আমরা ওই পাঁচজন দেখলাম ঢাকা জজ কোর্টের দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথের যে রাজপথ শাঁখারীবাজারের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তার দুই ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী-পুরুষের, কিশোর-শিশুর বহু পচা লাশ। দেখতে পেলাম, বহু লাশ পচে ফুলে বীভৎস হয়ে আছে। দেখলাম শাঁখারীবাজারের দুদিকের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলছে, অনেক লোকের অর্ধপোড়া লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম…প্রতিটি ঘরে দেখলাম মানুষ, আসবাবপত্র জ্বলছে। একটি ঘরে প্রবেশ করে একজন মেয়ে, একজন শিশুসহ ১২ জন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছি। শাঁখারীবাজারের প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশু ও বৃদ্ধের লাশ তুলেছি। পাঞ্জাবিরা প্রহরায় থাকাকালে সেই মানুষের অসংখ্য লাশের ওপর বিহারিদের উশৃঙ্খল উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম।’

লাশ আর লাশ 

চুন্নু আরো বলেছিলেন, ‘লাশ উঠাতে উঠাতে এক ঘরে প্রবেশ করে এক অসহায় বৃদ্ধাকে দেখলাম। বৃদ্ধা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন। আমি পানি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পেছনে সশস্ত্র পাঞ্জাবি সেনা প্রহরায় থাকায় আমি সেই বৃদ্ধাকে পানি দিয়ে সাহায্য করতে পারিনি। আমরা ২৮ মার্চ শাঁখারীবাজার থেকে প্রতিবারে ১০০ লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাকবোঝাই করে ৩০০ লাশ ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ২৯ মার্চ সকাল থেকে আমরা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর ও প্রবেশপথের দুই পাশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিববাড়ী, রমনা কালিবাড়ী, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে লাশ উঠিয়েছি।

২৯ মার্চ আমাদের ট্রাক প্রথম ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রবেশপথে যায়। আমরা হাসপাতালের প্রবেশপথে নেমে একটি বাঙালি যুবকের পচা, ফোলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। লাশ গলে যাওয়ার লোহার কাঁটার সঙ্গে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি। এরপর আমরা লাশঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-কিশোর ও শিশুর স্তূপীকৃত লাশ দেখলাম। প্রতিটি লাশ গুলিতে ঝাঁজরা দেখেছি, মেয়েদের লাশের কারো স্তন পাই নাই, যোনিপথ ক্ষতবিক্ষত এবং পেছনের মাংস কাটা দেখেছি।’

আরো পড়ুন: চাঁদ ও শুক্র গ্রহের বিরল দর্শন!

চুন্নু আরো বলেন, ‘৩০ মার্চ আমাদের ওই পাঁচজনের সঙ্গে দক্ষিণা ডোমকে সাহায্য করতে দেওয়া হয়। আমাদের ট্রাক সেদিন সাতমসজিদে যায়। আমি সাত মসজিদের সম্মুখ থেকে যখন বাঙালি লাশ উঠাচ্ছিলাম, তখন অসংখ্য বিহারি আমাদের চারদিকে দাঁড়িয়ে হাসছিল, বাঙালিদের পরিণতি দেখে উপহাস করছিল। আমরা সাতমসজিদের সম্মুখ থেকে আটটি বাঙালি যুবকের লাশ তুলেছি। কিছু লাশ দেখলাম উপুড় হয়ে আছে, সবার পিঠ গুলির অসংখ্য আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে আছে। পানি থেকে ১২টি লাশ তুলেছি, প্রতিটি লাশের চোখ ও হাত পেছন দিকে বাঁধা ছিল। নদীর পার থেকে ১২টি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁজরা দেখেছি। সাতমসজিদের সব লাশ তুলে আমরা ধলপুরের ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। মিন্টু রোডের রাস্তার পাশ থেকে প্যান্ট পরা দুটি পচা লাশ তুলেছি। ধলপুর যাওয়ার পথে ঢাকা স্টেডিয়ামের মসজিদের সম্মুখ থেকে এক বৃদ্ধ ফকিরের সদ্য গুলিবিদ্ধ লাশ তুলেছি। দেখলাম লাশের পাশেই ভিক্ষার ঝুলি, টিনের ডিব্বা ও লাঠি পড়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ীর সম্মুখ থেকে দুজন রূপসী যুবতী মেয়ে এবং তিনজন যুবকের ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলেছি। রোকেয়া হলে একটি অর্ধ দগ্ধ যুবতীর লাশ তুলেছি, মুসলিম হলে প্রবেশ করে একটি পচা লাশ পেয়েছি, ঢাকা হলের ভেতর থেকে চারজন ছাত্রের লাশ তুলেছি। পরের দিন ৩১ মার্চ বাসাবো খাল থেকে তিনটি পচা লাশ তুলেছি।’

সারা দিন লাশ তুলে অসুস্থ

ছোটন ডোমের বর্ণনা—‘২৮ মার্চ সকাল ৮টায় ঢাকা পৌরসভার সুইপার সুপারভাইজার পঞ্চম আমাদের নিতে আসেন। পাকিস্তানি সেনারা রাজধানী ঢাকার বহু লোককে নির্বিচারে হত্যা করার ফলে বিভিন্ন এলাকায় যেসব লাশ পচে ফুলে রাস্তায় পড়ে আছে, তা তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলার জন্য রেলওয়ে কলোনি থেকে আমাকে ও দুখী লালকে ডেকে নিয়ে যায়। আমার দলে আমি, দরবারী, মহেশ, কানাই, হরি ফেকওয়া এই ছয়জন ছিলাম। আমাদের ট্রাক রায়সাহেব বাজারের প্রবেশপথ দিয়ে গোয়ালনগরের স্কুল ও মন্দিরের সম্মুখে গিয়ে থামানো হয়। মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করে হাফ শার্ট ও হাফ প্যান্ট পরা এক চৌদ্দ বছরের সুন্দর ফুটফুটে ছেলের সদ্য মৃত লাশ দেয়ালে ঠেস দিয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম। ছেলেটিকে পেছন দিক থেকে হাত বেঁধে মাথার পেছনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সদ্য মৃত তাজা লাশ, হাত দিয়ে বড় আদরের সঙ্গে ট্রাকে তুলে দিলাম। কচি ছেলের তুলতুলে লাশ তুলতে গিয়ে আমার হৃদয় যেন কেঁপে উঠল। লাশটির ডাগর চোখের দিকে তাকাতেই আমার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগল অঝোরে। পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে রাস্তার ওপর আরো একটি যুবকের তাজা লাশ। মন্দিরের নিকটবর্তী বাড়ির অভ্যন্তরে রান্নাঘরে প্রবেশ করে সেখানে এক ঘরেই ১১টি পচা লাশ দেখলাম। একজন মাঝ বয়সী রূপসী মহিলা। প্রবেশপথে দুটি যুবক ও একজন কিশোরের লাশ দেখলাম। ঘরের ভেতরে পালঙ্কের নিচে থেকে আরো ছয় যুবক ছেলের লাশ তুলে আনলাম। পাশের ঘরে প্রবেশ করে দুজন যুবক ছেলে ও একজন মধ্যবয়সী লোকের পচা লাশ তুলেছি। পরে ধলপুর ময়লার ডিপোতে গিয়ে দেখলাম—বড় বড় গর্ত করে কুলিরা বসে আছে, ট্রাক থামিয়ে আমরা সব লাশ গর্তে ঢেলে দিলে কুলিরা মাটি ফেলে গর্ত বন্ধ করে দিল। লাশ উঠাবার জন্য আমাদের প্রত্যেককে মাত্র তিন টাকা করে দিলে আমি সারা দিন না খেয়ে লাশ তুলতে অস্বীকার করে চলে আসি। সারা দিন লাশ তুলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। পরের দিন থেকে আমি আর লাশ তুলতে যাই নাই।’


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts to your email.

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker