লালমনিরহাট

হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ-নির্যাতন দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি

১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই বিজয় মেনে নেয়নি আইয়ুব সরকার। তারা সরকার গঠনে বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বিভিন্নভাবে টালবাহানা শুরু করে। নিরীহ বাঙালিদের ওপর গুলি চালায়। পরে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলে বাঙালিদের অনুপ্রেরণা ও সাহস জোগায়। আমরা বাঙালিরা সেদিন আগে থেকে অস্ত্র হাতে তুলে নিইনি। দেশের প্রতি মায়া আর ভালবাসায় আমরা বাধ্য হয়েছিলাম। এরপরেই শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর পড়া লেখা ছেড়ে রংপুর থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসি। তখন পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর গতিমতি ভালো ছিল না। সবার ধারণা ছিল, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। হঠাৎ ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতভাবে হামলা শুরু করে। পরদিন ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আবাল, বৃদ্ধা, বনিতা সবাই ঝাপিয়ে পড়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে স্বাধীনের জন্য।

তখন আমার বাবার সহযোগিতায় আমাদের এলাকাতেই অবাঙালিদের হত্যা করে তাদের অস্ত্রগুলো ছিনিয়ে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি আমরা। চারদিকে শুরু হয় তুমুল প্রতিরোধ। পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা তখন বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ-নির্যাতন করে। এসব দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারিনি।

পাকিস্তানিদের অত্যাচারে দিনরাত সমানে চলত শুধুই আহাজারি। রাত হলেই জ্বলে উঠত আগুন। পরের দিনে রাস্তা ঘাটে, গর্তে, জঙ্গলে পড়ে থাকত অসংখ্য নারী-পুরুষের লাশ। ক্ষত-বিক্ষত শরীরগুলো কখনো উলঙ্গ, আবার কখনো ছিল সামান্য কিছু কাপড়ে মোড়ানো। বাড়িঘরে আগুন, লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিত্য দিনের ঘটনা। এ দৃশ্য চোখের সামনে বারবার পড়লে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারিনি। চলে গেলাম মুক্তিযুদ্ধে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের আশায়। যুদ্ধে জয়ী হয়েই দীর্ঘদিন পর ফিরে আসি মা-বাবার কাছে।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় অংশগ্রহণের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতিমাখা এবং বাস্তব কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা লিডার ড: এসএম শফিকুল ইসলাম কানু। মুক্তিযুদ্ধে তার  স্মৃতিমাখা সেসব স্মৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করেন প্রতিদিনের সংবাদের এ প্রতিনিধি।

সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের লোহাকুচির গ্রামে বসবাস শফিকুল ইসলাম কানুর। ১৯৭০ সালে তিনি রংপুরের বদরগঞ্জ কলেজের ছাত্র ছিলেন। রাজনীতির হাতে খড়ি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন থেকে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ১৯৬৯ এর গণ-আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন কানু। তার বাবা অলি উদ্দিন আহমেদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। ১১ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় এসএম শফিকুল ইসলাম কানু। তার দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে লেফট্যানেন্ট কর্নেল, ছোট ছেলে ববসায়ী।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কানু বলেন, মা-বাবার দোয়া ও আশীর্বাদ নিয়ে যুদ্ধে আমি যাত্রা করি। পরিবার সাহস না দিলে হয়তো দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তাম না। ওই দিন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি এক কাপড়ে।

ঝড়-বৃষ্টি, গরম-শীত সবই এই এক কাপড়েই কেটেছে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ভাবার সময় ছিল না। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, তার থেকে দেশকে শত্রুমুক্ত করার ক্ষুধা ছিল আরও তীব্র। তবে পাকিস্তানী দোসরদের দেওয়া যন্ত্রণা আমাদের খুব ভাবিয়ে তুলেছিল। কারণ, আমাদের লক্ষ্য ছিল দেশ স্বাধীন করা পর্যন্ত লড়ে যাওয়া।

মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, যুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করার দৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখেছি। এসব দৃশ্য এখনো চোখে ভাসলেই আঁতকে উঠি। পাকিস্তানি হানাদাররা যে কত নিষ্ঠুর ছিল, তা বর্ণনা করে শেষ করার মতো নয়। বিশেষ করে নারীদের প্রতি তারা সবচেয়ে বেশি অমানবিক অত্যাচার করেছে। পরিবারের সামনেই নারীদের ধর্ষণ ও সবাইকে গুলি করে হত্যা করত। এসব দৃশ্য এখনো চোখে মুখে ভেসে ওঠে। আমরা এখন অনেক শান্তিতে রয়েছি। যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো, তাহলে দেশের মানুষ বুঝত পাকিস্তান আমলে আমরা কতটা অসহায় ছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগে প্রথমে ভারতের সীতাইতে যান কানু। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেন। পরে কুচবিহার জেলার তুর্ষা নদী পার হয়ে টাপুরহাট বিএসএফ ক্যাম্প থেকে মুজিব ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেন।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে তাকে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। থ্রিনটথ্রি রাইফেল, স্টেনগান, এসএলআর, এসএমজিসহ বিভিন্ন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। প্রায় দেড় মাসের প্রশিক্ষণে নিজেকে পাকিস্তানি আর্মিদের বিরুদ্ধে গেরিলাযোদ্ধা হিসাবে তৈরি করতে সক্ষম হই।

প্রশিক্ষণ শেষে পশ্চিমবঙ্গের সীতাইতে ক্যাম্প স্থাপন করি আমরা। সেটি বাংলাদেশের হাতীবান্ধার পাশেই। সেখানে আমরা প্রতি রাতে পাকিস্তানি আর্মির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে দুপক্ষের গোলাগুলি শুরু হতো। আমরা যে অঞ্চলে যুদ্ধ করি, সেটি ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন খাদেমুল বাসার। পরবর্তীতে তিনি বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া আমার কোম্পানি কমান্ডার মাহাতাব উদ্দিন (বীর প্রতীক) ও আমি ওই কোম্পানির টু-আইসি ছিলাম। আমি নিজে মুক্তিযোদ্ধার একটি প্লাটুন পরিচালনা করি।

ওই সময় পাকিস্তানি আর্মিদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বিভিন্ন স্থানের রেললাইন তুলে ফেলতাম। এ ছাড়া টেলিফোনের তার কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতাম। রেল লাইনের সেতুগুলো বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিই। এতে পাকিস্তানি আর্মিরা তাদের সহ-যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের প্রতি আক্রমণ করি। এভাবেই সম্মুখযুদ্ধে আমাদের সঙ্গে না পেরে পাকিস্তানিরা পিছু হটে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করার পর ৬ ডিসেম্বর লালমনিরহাট হানাদারমুক্ত হয়।

এর তিন দিন পরে অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর হাতীবান্ধা থেকে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা করেন তিনি। তখনো দেশ পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়নি। খুনিয়াগাছ হয়ে হারাগাছ দিয়ে রংপুর শহরে পৌঁছান তিনি। মুক্তি বাহিনী যত অগ্রসর হতে থাকে, ততই পরাস্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা পিছু হটতে থাকে। অবশেষে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসর্মপণের মধ্যে দিয়ে দেশ পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত হয় বলে থামেন শফিকুল ইসলাম কানু।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর তার আহ্বানে সবার সঙ্গে অস্ত্র জমা দেন শফিকুল ইসলাম। এ সময় তাকে ৩০ টাকা দেওয়া হয়েছিল।

শফিকুল ইসলাম বলেন, অস্ত্র জমা দেওয়ার পর তাকে ৩০ টাকা দেয়া হয়েছিল। তখন তার শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। পায়ে স্যান্ডেলও নেই। ওই টাকা থেকে কিছু কাপড় আর জিনিসপত্র কিনেছিলাম। এরপরেও হাতে ছিল আরও ১৩ টাকা। সেই ১৩ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। শত্রুকে খতম করেই বাড়ির দিকে রওনা হই। দীর্ঘদিন পর বাড়ি পৌঁছালে আমার বাবা-মা আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরিবারের সবাই আমাকে দেখে বুকে জড়িয়ে নেন। যুদ্ধ শেষে বাড়িতে ফিরে আসব এটা ছিল কল্পনাতীত। তাই অশ্রুসিক্ত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন বাড়ির সকল মানুষ।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থায় দেশ আজ অনেক এগিয়েছে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা। কিন্তু এতো প্রাপ্তির পরেও মন ভরেনি শফিকুল ইসলামের। তিনি ব্যথিত হন, যখন শোনেন নতুন নতুন অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম।

অনেকটা আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, যারা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তারাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে। কিন্তু এতদিন পর আজ আমরা কী দেখছি? ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সময়ে একটি প্রজ্ঞাপন গেজেট আকারে প্রকাশ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই গেজেট মানা হয়নি। বরং ১৬ বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে। যেখানে ৮০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল, আজ সেখানে আড়াই লাখের অধিক মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করা হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া, কষ্টদায়ক ও হতাশার।”

মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে তিনি বলেন, আজও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। আরও কষ্ট লাগে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার এখন রাজনৈতিক ও আত্মীয়তার আশ্রয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা আমার লজ্জা, বিষয়টি আমাদের জন্য অনেক বেদনাদায়ক। জীবনের মায়া ভুলে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করেছি। তখন যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে, আজ তারাই নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে।

লালমনিরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার মেজবাহ উদ্দিন আহমেদের দাবী বর্তমানে হিসাব ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে শুধু লালমনিরহাটেই।

তিনি বলেন, প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি না কখন কীভাবে বেড়ে যায়। এ নিয়ে আমরা ভীষণ চিন্তিত। বর্তমানে জেলায় কতজন ভাতা পাচ্ছেন, কতজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আছেন, সেটিও আমাদের জানিনা। মুক্তিযোদ্ধা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখার আহবান জানান। আর তা না হলে এটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker