সারাদেশ

ছেলের মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ মা, বলা হয়নি স্বামীও চলে গেছেন

ফারদিন আরাফাত স্বাধীনের (২২) স্বপ্ন ছিল নাবিক হয়ে জাহাজে দেশ-দেশান্তরে ঘুরবেন। সেই স্বপ্ন পূরণের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে যান তিনি। সব পরীক্ষা শেষ করে এখন নাবিকের স্বীকৃতির অপেক্ষায়। আগামী মাসেই নাবিক হিসেবে একটি জাহাজে ব্রাজিল যাবার কথা তার। স্বাধীনের বাবা কতুব উদ্দিনও জাহাজে সুয়ানি (চালক) হিসেবে কর্মরত। তাই বিদেশে যাবার সাথে বাবার জাহাজে একবার ঘুরে বেড়ালে অভিজ্ঞতা হবে। এমন ভাবনা থেকে বাবার কর্মস্থল এমটি ইবাদি-১ জাহাজে চলে যান স্বাধীন। সেখানেই ভ্রমণ করছিলেন। 

কিন্তু গত ১১ মে বিকালে যশোরের কীর্তনখোলা নদীতে নোঙর করা অবস্থায় হঠাৎ ওই জাহাজের তেলের ট্যাংকারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে যায়। এতে ঘটনাস্থলে সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের নিউ রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা কতুব উদ্দিনের ছেলে স্বাধীনসহ সাতজন নিহত হন। এছাড়া গুরুতর আহতদের তালিকায় ছিলেন তার বাবা কতুব উদ্দিনসহ আরো অনেকে। তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে ভর্তি করানো হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার রাতে মারা যান স্বাধীনের বাবা কতুব উদ্দিনও। এর মধ্য দিয়ে মাত্র চার দিনের ব্যাবধানে প্রাণ গেল বাবা ও ছেলের।

এদিকে, এসব ঘটনা ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকার সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। নিহত স্বাধীনের তিন বোন ও মা আছে। বোনেরা বিবাহিত। তাই শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। ফলে এ ঘটনার পর তাদের বৃদ্ধা মা একা হয়ে গেলেন। তবে লাশ এখনো পোস্টমর্টেমে থাকায় বাড়িতে আনা যায়নি।

স্বাধীনের নিকটাত্মীয়রা জানান, চার দিন আগে ছেলে স্বাধীনকে হারিয়ে এখনো বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন মা। এবার মারা গেলেন তার স্বামীও। কিন্তু এত শোক তিনি সইতে পারবেন কিনা এ ভয়ে কেউ তাকে এখনো (সোমবার বিকাল পর্যন্ত) স্বামীর মৃত্যুর খবর দেননি। তবে বাড়িতে একের পর এক আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা আসতে থাকায় তিনি বার বার জানতে চাইছেন এখানে এত মানুষ কেন? 

স্বাধীনের মামা নিয়াজ মোরশেদ জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রথম দিন আমার ভাগিনা নিহত হয়। একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে আমার বোন বাকরুদ্ধ। তারমধ্যে ভগ্নিপতি মারা যায় গতরাতে। এখনো আমার বোন জানেন না যে তার স্বামী মারা গেছে। কি বলে স্বান্তনা দেবো বোনকে,  ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। 

তিনি আরো বলেন, আমার বোনের তিন মেয়ে এক ছেলে। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। একমাত্র ছেলেকে মেরিন একাডেমিতে পড়ালেখা করিয়েছেন। আগামী মাসেই নাবিক হিসেবে ব্রাজিলে চলে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগে অভিজ্ঞতার জন্য বাবার সাথে তেলবাহী জাহাজে করে চট্টগ্রাম হয়ে বরিশালে যান। দুর্ঘটনার দিন সকাল ১১টার দিকে স্বাধীন তার মাকে বলেন, মেয়ে তিনটাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আমি ব্রাজিলে যাওয়ার আগে যদি আমাকে বিয়ে করায় দিতেন তাহলে আপনাকে আর একা থাকতে হতো না। আমি ব্রাজিল চলে যাব আপনাকে এখন ঘরে একা থাকতে হবে। কিন্তু বিকেল বেলা জাহাজে বিস্ফোরণের ঘটনায় সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ঘটনাস্থালেই মারা যান স্বাধীন। ভগ্নিপতিকে আহত অবস্থায় ভর্তি করা হয় ঢাকা বার্ন ইউনিট হাসপাতালের আইসিইউতে। রবিবার রাতে তিনিও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। 

কুতুব উদ্দিন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের নিউ রাজাপুর গ্রামের মৃত ছালে আহমদের পুত্র।

কুমিরা এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান মোর্শেদ হোসেন চৌধুরী বলেন, মাত্র চার দিনের মধ্যে বাপ-ছেলের মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আর পরিবারটিতে বৃদ্ধ মা ছাড়া আর কেউ রইল না। ছেলে স্বাধীনের লাশ পরদিন দাফন হয়। কিন্তু এখনো কুতুবউদ্দিনের লাশ বাড়িতে আসেনি। আমরা তাদেরকে স্বান্তনা দেবার কোনো ভাষা পাচ্ছি না। 

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker