জাতীয়

সিনহা হত্যা মামলায় প্রদীপ ও লিয়াকতের ফাঁসি

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ ও বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দীনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। 

এছাড়া মামলা থেকে এপিবিএনের এসআই শাহজাহান আলী, কনস্টেবল মো: রাজীব, মো: আব্দুল্লাহ, পুলিশের কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, লিটন মিয়া ও পুলিশের কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুনকে খালাস দেওয়া হয়।

সোমবার (৩১ জানুয়ারি) বিকাল ৪টা ২২ মিনিটের দিকে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় ঘোষণা করেন। এসময় ১৫ আসামিই আদালতে উপস্থিত ছিলেন।  

এদিকে তিনশ’ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘আমি মেজর সিনহা হত্যা মামলার বিভিন্ন ইস্যু ও খুঁটিনাটি বিষয় খোঁজার চেষ্টা করেছি। এতে এপিবিএনের তিন সদস্য দায়িত্বে ছিলেন। এ তিন জনই প্রথমে সিনহার গাড়িটি আটকানোর পর ছেড়ে দেন। পরে পুলিশ পুনরায় গাড়িটি আটকালো এবং ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে গুলি করা হয়। এতে প্রমাণিত হয় সিনহা হত্যা একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’

বিচারকের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়- সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের সাক্ষ্যের বিবরণীতে জানা যায় চার রাউন্ড গুলি করে লিয়াকত আলী। এছাড়া লিয়াকতের জবানবন্দিতে ওসি প্রদীপ সিনহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন বলেও জানা যায়। সিনহার হাতে পিস্তল আছে ভেবে লিয়াকত গুলি করার কথা স্বীকারও করেছেন। শেষ পর্যন্ত ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে পৌঁছে সিনহার বামপাশে লাথি মারেন এবং সিনহা নিস্তেজ হয়ে যান।
 
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়- একইভাবে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতের জবানবন্দিতেও উঠে আসে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি। জবানবন্দিতে নন্দ দুলাল বলেন- লিয়াকত আগে থেকে সিলভার কালারের গাড়ি থামাতে বলেন। পরে দুই হাত উঁচু করে সামনের দিকে ঝুঁকে থাকা অবস্থায় সিনহাকে চার রাউন্ড গুলি করেন লিয়াকত। প্রদীপ ঘটনাস্থলে এসে বলেন, অনেক কষ্টের পর তোকে পেয়েছি। এরপর বুকে বাম পাশে লাথি মারেন এবং সিনহা নিস্তেজ হয়ে যান। ওসি প্রদীপের ভয়ে জব্দ তালিকা তৈরি করি। মূলত ওসি প্রদীপ যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন আমি সেভাবে করেছি। এতে করে হত্যায় ঘটনাস্থলে লিয়াকত, নন্দ দুলালের সক্রিয় ভূমিকা রাখার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। 

 মামলার আসামিরা ছিলেন- টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ও বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলী, প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল­াহ আল মামুন, বরখাস্ত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

এদিকে সিনহা হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে সকাল থেকেই কক্সবাজার আদালত প্রাঙ্গণে ছিল কড়া নিরাপত্তা। খুব সকালে আদালতে পৌঁছানোর পর প্রধান ফটক থেকে শুরু করে এজলাস পর্যন্ত যেতে কয়েক দফা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিবন্ধকতা পার হতে হয়। ঢাকার বাইরে কোনও মামলার রায়ের জন্য এমন কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ বিরল। এ ধরনের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা স¤প্রতি শুধুমাত্র ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের সময়েই দেখা গিয়েছে। বিচারক আসার বেশ আগেই এজলাসকক্ষ গমগম করছিল সাংবাদিক এবং আইনজীবীদের উপস্থিতিতে। স্থানীয় সাংবাদিকদের বাইরেও ঢাকা থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা কক্সবাজার আদালতে এসে উপস্থিত হয়েছেন।

এদিকে গত বছর ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে মামলাটির বিচারকাজ শুরু হয় এবং চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি সর্বশেষ দুই আসামির পক্ষে তাদের আইনজীবীদের যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বিচারকাজ শেষ হয়। পরে বিচারক ৩১ জানুয়ারি রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন।  হত্যাকাণ্ডের আঠারো মাস পর এ মামলার রায় হতে চলেছে। আর ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি চায় সিনহার পরিবার।

পরিবারের পাশাপাশি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছে। আসামিপক্ষ বলছে, রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কাজেই তারা খালাস পাবেন।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়ার শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি (টেকনাফে দুটি, রামুতে একটি) মামলা করেছিল।

সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া সিনহা ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য সেসময় প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। ওই কাজে তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপা দেবনাথ।

তবে কক্সবাজারের পুলিশ সে-সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে। ঘটনার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে র‌্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। তদন্ত শেষে র‌্যাব ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts to your email.

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker