জাতীয়

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, এক প্রশ্নের দামই ১৫ লাখ টাকা

অবশেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সত্যতা পেয়েছেন গোয়েন্দারা। ফাঁস চক্রের সদস্যরা প্রথম ব্যক্তির কাছে একটি প্রশ্ন বিক্রি করে ১৫ লাখ টাকায়। সেই প্রশ্ন হাত বদল করে কোটি কোটি টাকা পকেটে তুলেছে চক্রের সদস্যরা।

যারা প্রশ্ন ফাঁস করেছেন এবং যারা প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিয়েছেন তাদের ১০ জনকে আটক করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা। এদের মধ্যে দুজন এর আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিয়ে ব্যাংকের চাকরি পান। তখন থেকেই প্রশ্ন ফাঁস চক্রে জড়িত তারা। এ চক্রে জড়িত তেজগাঁওয়ের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কেও খোঁজখবর নিচ্ছেন গোয়েন্দারা।

শনিবার নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পরই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ করেন অনেক চাকরিপ্রত্যাশী। তাদের অভিযোগ ছিল, পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০০টি প্রশ্নের প্রিন্ট করা উত্তরপত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পাওয়া গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার তদন্তে বের হয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অভিযোগের সূত্র ধরে প্রাথমিক তদন্তে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ৫টি ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি সত্য। প্রশ্নপত্র যারা ফঁাঁস করেছেন এবং যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছেন তাদের ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় টেন্ডারের মাধ্যমে এ প্রশ্নপত্র তৈরি ও পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। প্রথম ব্যক্তি ১৫ লাখ টাকায় একটি প্রশ্নপত্র কিনেন। পর্যায়ক্রমে সবাইকে ধরা হবে।

এ প্রসঙ্গে শনিবার ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্য ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পরীক্ষায় আবেদনকারীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ অংশ নিয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কোনো ঘটনা আমাদের নজরে আসেনি। এমন কিছু হলে পরীক্ষার আগেই শোনা যেত।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় পাঁচ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় শনিবার বেলা তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত। ১ হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন চাকরি প্রত্যাশী। একাধিক প্রার্থীর দাবি, পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০০টি প্রশ্নের প্রিন্ট করা উত্তরপত্র ফেসবুকে পাওয়া গেছে। ফেসবুকে উত্তরপত্র ছড়ানোর ঘটনায় চাকরিপ্রার্থীরা প্রশ্ন তোলেন, পরীক্ষা চারটায় শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ১০০টি প্রশ্নের ‘সঠিক উত্তর’ ফেসবুকে পাওয়া সম্ভব নয়। এটা প্রমাণ করে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

পুলিশ জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগের সূত্র ধরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একটি দল তদন্তে নামে। প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তথ্য সংগ্রহের পর দুদিন টানা অভিযান চালায় দলটি। ঢাকা, সাভার ও উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁওয়ে অভিযানকালে গোয়েন্দা জালে আটক হয় ১০ জন। এদের মধ্যে জামালপুরের স্বপন, জাহিদ, জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার ইমদাদুল হক খোকন, পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মুস্তাফিজুর রহমান মিলন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র (চাকরি প্রার্থী) সাজ্জাদ হোসেন শিহাবের নাম জানা গেছে। এদের ঢাকা মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, এই চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার ইমদাদুল হক খোকন প্রশ্ন ফাঁস চক্রে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি নিজেও ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নেন। এরপর থেকে ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে জড়িয়ে যান তিনি।

এই অনৈতিক কাজের মাধ্যমে তারা চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তবে এবারের কৌশল একটু ভিন্ন বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। এবার চক্রের সদস্যরা রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকা থেকে পাওয়া প্রশ্নপত্র অনুযায়ী সঠিক উত্তর লিখে তা বিপুল টাকার বিনিময়ে চাকরি প্রার্থীদের কাছে বিক্রি করেন। আটককৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য দু-এক দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরা হতে পারে।

গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে হয়। নিয়োগ কমিটি সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেন। আর পরীক্ষা নেওয়ার জন্য তারা দরপত্র আহ্বান করে। এবার ৫টি রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংকে নিয়োগের এ পরীক্ষা নেওয়ার কাজ পায় তেজগাঁওয়ের একটি বেরসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকেই মূলত প্রথমে প্রশ্ন ফাঁস হয়।

ডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারকৃত ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই ব্যাংক কর্মকর্তা। আর ২ জন চাকরি প্রার্থী পরীক্ষার্থী। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একজন প্রথম ১৫ লাখ টাকায় একটি প্রশ্ন কেনেন। এরপর তিনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে ওই প্রশ্ন বিক্রি করেন। তার মাধ্যমেই চক্রের অন্য সদস্যরা এ প্রশ্ন বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। সর্বনিম্ন ৩ লাখ টাকায় একটি প্রশ্ন বিক্রি হয় বলে গোয়েন্দারা জানতে পারেন।

২০১৭ সালের ১৯ মে অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগের বাছাইপর্বের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। পরে ওই পরীক্ষা বাতিল করা হয়। ২০১২ সালে জনতা ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছিল র‌্যাব।


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts to your email.

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker