আন্তর্জাতিক

টাইটানের নিরাপত্তা নিয়ে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল

নিখোঁজ হওয়া টাইটান ডুবোযানটি যে কম্পানি চালায় সেই ওশানগেটের এক সাবেক কর্মকর্তা ২০১৮ সালেই এর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের কিছু নথিতে দেখা যায়, কম্পানিটির মেরিন অপারেশনের পরিচালক ডেভিড লকরিজ তার এক প্রতিবেদনে এর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অনেকগুলো জায়গা শনাক্ত করা হয়েছে, যা নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি।’ একইসাথে এটা যেভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে সে নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।

লকরিজ মত দেন, ‘এই ডুবোযান যখন পানির একেবারে গভীরে যাবে তখন সেখানে থাকা যাত্রীদের জন্য সেটি মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে।’ তিনি বলেন, তার এই সতর্কতা উপেক্ষা করা হয়েছে। তিনি যখন ওশানগেট বসের সঙ্গে বৈঠক ডাকেন তখন তাকে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে এই নথি থেকে জানা যায়।

কম্পানি তার বিরুদ্ধে গোপনীয় তথ্য প্রকাশের অভিযোগে মামলাও করে, আর তিনিও পাল্টা মামলা করেন তাকে অনৈতিকভাবে ছাঁটাই করার জন্য।

পরে দুপক্ষই মামলার বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় আসে। তবে বিস্তারিত আর কিছু জানা যায়নি।

বিবিসি লকরিজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে, কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ ছাড়া ওশানগেটকে ২০১৮ সালের মার্চে আলাদাভাবে একটা চিঠি দেয় মেরিন টেকনোলজি সোসাইটি (এমটিএস), যা নিউ ইয়র্ক টাইমসের হাতে আসে এবং এতে লেখা হয়, ‘যেভাবে ওশানগেট এটার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, তার ফলাফল নেতিবাচক হতে পারে (সামান্য থেকে ভয়াবহ বিপর্যয় পর্যন্ত)।

টাইটান ডুবোযান, যেটাকে কম্পানিটি বর্ণনা করে পরীক্ষামূলক হিসেবে, সেটি কিছু ভিন্ন উপকরণে নির্মিত হয়, যা সাধারণত গভীর সমুদ্রযানে দেখা যায় না। এটার যে প্রধান কাঠামো, যেখানে যাত্রীরা বসে তার চারপাশ কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি, এর সাথে ব্যবহার হয় টাইটানিয়ামের প্লেট এবং একপাশে একটা ছোট জানালা রাখা হয়।

পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন বায়োলজি বিষয়ের লেকচারার ড. নিকোলাই রটেরডাম বলেন, ‘সাধারণত গভীর সমুদ্রের ডুবোযান, যা মানুষ বহন করে সেটি প্রায় দুই মিটার ব্যাসরেখার টাইটানিয়াম স্ফেয়ারের হয়ে থাকে।’ পানির গভীরে যে প্রচন্ড চাপ তৈরি হয়, সেটার মোকাবেলায় আপনার খুবই শক্তিশালী উপাদান লাগবে, যাতে পানির ওজন, যা আপনাকে প্রতিনিয়ত নিচের দিকে নিতে থাকে সেটা আপনি এড়াতে পারেন। কার্বন ফাইবার টাইটানিয়াম স্টিলের চেয়ে কম দামি, কিন্তু এটাও খুবই শক্তিশালী।

কিন্তু টাইটানের মতো গভীর সমুদ্রের ডুবোযানের ক্ষেত্রে তা এখনো পরীক্ষিত নয়।

গত বছর ওশানোগ্রাফিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ওশানগেটের প্রধান নির্বাহী রাশ টকটন বলেন, ‘কার্বন ফাইবার ইয়ট এবং এভিয়েশনে সাফল্যের সঙ্গেই ব্যবহার হচ্ছে, তবে ডুবোযান যাতে মানুষ থাকে সেখানে এখনো ব্যবহার করা হয়নি।’

আদালতের নথিতে লকরিজ দাবি করেন, এর কাঠামো কতটা চাপ নিতে পারে এবং এর সম্ভাব্য সমস্যাগুলো কি তা যথাযথভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। তার দাবি, এটি কতটা চাপ নিতে পারে সেটার একটা ছোট স্কেলে পরীক্ষার সময় এই ডুবোযানের কার্বন ফাইবারে বেশ কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে।

একইসঙ্গে টাইটানের যে জানালা রাখা হয় সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন লকরিজ। তিনি বলেন, যারা এটি বানিয়েছে তাদের সেই উপকরণ তখনই স্বীকৃতি পাবে যখন তা এক হাজার ৩০০ মিটার গভীরে ব্যবহার করা হবে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ওশানগেট এক বিবৃতিতে জানায়, টাইটান চার হাজার মিটার গভীর পর্যন্ত গিয়েছে, যা ‘এর কার্বন ফাইবার ও টাইটানিয়াম কাঠামোর ব্যাপারে ওশানগেটের উদ্ভাবনী প্রকৌশল ও নির্মাণকে নিশ্চিত করে’।

২০২০ সালে গিকওয়্যারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাশ বলে, পরীক্ষায় ডুবোযানটি ‘টানা ব্যবহারে কিছু ক্লান্তির ছাপ’ দেখিয়েছে।

২০২১ সালের মে মাসে আদালতের নথিতে বলা হয়, কম্পানিটি জানিয়েছে, টাইটান ৫০টিরও বেশি টেস্ট ড্রাইভ দিয়েছে, টাইটানিকের সমপরিমাণ গভীরে গেছে, বাহামার গভীর সমুদ্রে গেছে এবং একটা প্রেশার চেম্বারেও এটি নেমেছে।

টাইটানের কাঠামোটাও একটু ভিন্নরকম। গভীর সমুদ্রের ডুবোযানের আকৃতি সাধারণত গোলাকার হয়ে থাকে, যাতে সবদিকে এটি সমান চাপ নিতে পারে। কিন্তু টাইটান টিউব আকৃতির, ফলে এতে সবদিকে চাপ সমানভাবে যায় না।

অনুমোদন ছিল না কেন?
আদালতের নথিতে লকরিজ বলেন, ওশানগেট যাতে এই সাবমেরিনটা পরিদর্শন করায় এবং সার্টিফিকেট পায় সে ব্যাপারে জোর দিয়েছিলেন।

ডুবোযানের স্বীকৃতি দিতে পারে মেরিন প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন আমেরিকান ব্যুরো অব শিপিং (এবিএস) বা ডিএনভি নরওয়েভিত্তিক একটি বৈশ্বিক অ্যাক্রিডিটেশন সংস্থা কিংবা লয়েডস অব লন্ডন। এর মানে হলো যানটিকে স্থায়িত্ব, সামর্থ্য, নিরাপত্তা ও পারফরম্যান্স—এমন নানা দিকে কিছু নির্দিষ্ট মান পূরণ করতে হবে। যে প্রক্রিয়ায় এর নকশা ও নির্মাণ পর্যালোচনা করা হয়, ট্রায়াল দেখে তারপর সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। আর একবার যখন ডুবোযান চলা শুরু করবে তারপর থেকে এটি নিয়মিত কিছুদিন পরপর পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে এটা সমস্ত মান নিশ্চিত করে চলেছে।

তবে ডুবোযানের স্বীকৃতির ব্যাপারটি বাধ্যতামূলক নয়। ২০১৯ সালে কম্পানি তাদের এক ব্লগ পোস্টে লেখে, টাইটান কখনোই কোনো স্বীকৃতি পায়নি।

এটা অনেকটা এভাবে বলা হয়, টাইটান যেভাবে নকশা করা হয়েছে তাতে সেটি প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ছে না। কিন্তু ‘এর মানে এটাও নয় যে ওশানগেট প্রয়োজনীয় মান পূরণ করেছে’।

এতে যোগ করা হয়, প্রথাগত সংস্থাগুলো ‘উদ্ভাবনের গতি কমিয়ে দেয়…যে কোনো উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাস্তব বিশ্বে পরীক্ষার আগে একটা বাইরের সংস্থাকে নিয়ে আসা দ্রুত উদ্ভাবনীর ক্ষেত্রে অভিশাপ’।

২০২২ সালে টাইটানে যাওয়া এক সিবিএস রিপোর্টার মন্তব্য করেন, ‘এটি একটি পরীক্ষামূলক ডুবোযান, যা কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদিত নয় এবং এটি আপনার শারিরীক ইনজুরি, মানসিক ট্রমা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।’ যাত্রা শুরুর আগে এরকম লেখা কাগজে স্বাক্ষর করতে হয় যাত্রীদের।

যেকোনো সাব, যা চার হাজার মিটার গভীরে যায়, এগুলো খুবই বিরল ধরণের যান। যা খুব বেশি দেখা যায় না এবং এর জন্য উদ্ভাবন ও নকশাটা অনন্য হতে হয়, যাতে এত গভীরে এটি টিকে থাকতে পারে। তবে এর মানে আবার এটাও নয় যে প্রথাগতভাবে এর স্বীকৃতি প্রদান হবে না। উদাহরণস্বরুপ আরেকটা ডুবোযান লিমিটিং ফ্যাক্টর। এটির নির্মাতা ট্রাইটন সাবমেরিন, যা নিয়মিত সমুদ্রের গভীরে ভ্রমণ করেছে, এমনকি ১১ কিলোমিটার গভীরে ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের নিচ পর্যন্ত গেছে।

এই যানটি প্রকৃতপক্ষেই অনন্য ধরণের এবং অত্যাধুনিক। তবে এই দলটি এর নকশা, নির্মাণ ও পরীক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিএনভির ক্লাসিং এজেন্সির সঙ্গে মিলে কাজ করেছে। আর লিমিটিং ফ্যাক্টর সমুদ্রের যেকোনো গভীর পর্যন্ত একাধিকবার নিরাপদে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি অনুমোদিত।

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker