ইতিহাস ও ঐতিহ্য

টাইটানিক কি সত্যিই ডুবেছিলো? জেনে নিন অজানা তথ্য

টাইটানিক, এই নামের সিনেমার কথা কিংবা জাহাজের কথা না জানা মানুষের সংখ্যা বোধ হয় কমই আছে। টাইটানিক জাহাজের ডুবে যাওয়ার ঘটনা সর্বকালের আলোচিত নৌ দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। ১৯০৮ সালে আইরিশ হারলেন্ড এবং ওলফস বিল্ডার কোম্পনিকে এই জাহাজ বানানোর অর্ডার দেয় হোয়াইট স্টার লাইন নামের বৃহৎ জাহাজ ব্যবসায়ী কোম্পানি।

জাহাজটির ডিজাইনের দায়িত্বে ছিলেন প্রাক্তন নেভাল স্থপতি হারলেন্ড এবং ওলফস বিল্ডারের ডিজাইন ডিপার্টমেন্ট এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর থমাস এন্ড্রুস, কোম্পানির চেয়ারম্যান, থমাসের চাচা লর্ড উইলিয়াম জেমস পেরি এবং জেমস পেরির শ্যালক; জাহাজের প্রধান ড্রাফটসম্যান আলেক্সান্ডার কারলিসল। তবে পরবর্তীতে টাইটানিক জাহাজে কমসংখ্যক লাইফবোট রাখা নিয়ে মিস্টার পেরির সাথে মতবিরোধ হয়ে আলেক্সান্ডার চাকরি ছেড়ে দেন। হোয়াইট স্টার কোম্পানির বানানো তিনটি অলিম্পিক ক্লাস লাইনারের মধ্যে অন্যতম হলো টাইটানিক, বাকি দুইটির নাম ছিল ব্রিটানিক এবং অলিম্পিক।

এই দুই জাহাজের সাথে টাইটানিকের প্রায় সবরকম মিল থাকলেও হোয়াইট স্টার লাইনের চেয়ারম্যান ব্রুস ইসমের নির্দেশে টাইটানিকে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। অন্যদের মতো টাইটানিকেও স্লাইডিং উইন্ডোর সাথে স্টিলের স্ক্রিন ছিল কিন্তু এতে ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জাররা যেন নিরাপদে সমুদ্র দেখতে পারে তার জন্য ডেকে এক্সট্রা ব্যাবস্থা করা হয়। কুনারড লাইন অফ শিপের মৌরিতানিয়া এবং লুসিতানিয়া নামক জাহাজদের সাথে পাল্লা দেওয়ার উদ্দ্যেশ্যেই টাইটানিকে এমন পরিবর্তন আনা হয়। জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে নেওয়া হয় কোম্পানির অনেকদিনের অভিজ্ঞ এবং সফল ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথকে। তিনি টাইটানিকের এই সফরটা শেষ করেই অবসর নিতে চেয়েছিলেন।

সে সময় টাইটানিক ছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় জলযান, এবং নিউইয়র্কে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি এটি আমেরিকান পোস্ট অফিস এবং রয়েল মেইলের আন্ডারে মেইল শিপ হিসেবেও কাজ করত। ১৯১২ সালের এপ্রিল মাসে জাহাজটি যাত্রা শুরু করে দেয় ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দর থেকে, পরে ফ্রান্স এবং আয়ারল্যান্ডে থেমে এটি আরো যাত্রী নেয়। জাহাজে প্রায় ১৩১৭ জন মানুষ ভ্রমন করছিল এবং নিউইয়র্কে তার পৌঁছানোর তারিখ ছিল ১৭ই এপ্রিল।

হোয়াইট স্টার লাইন কোম্পানিটি এই জাহাজকে সে সময় “আনসিংকেবল” বলে ঘোষণা দেয় এবং ক্যাপ্টেন স্মিথ বলেছিলেন যে, তিনি এমন কোনো পরিস্থিতির কথা চিন্তাই করতে পারেন না যা এই জাহাজকে ডুবাতে পারে। কারন আধুনিক জাহাজ নির্মাণ শিল্প এখন এ সবের বাইরে। তাই আইসবার্গ ওয়ারনিং, লাইফবোট, লাইফ জ্যাকেট এবং অন্য সব বিষয়ে খুব কম মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল।

কেন এই বিপর্যয়

টাইটানিকের ডুবে যাওয়ার মতবাদগুলোর মধ্যে আইসবার্গ থিওরি অন্যতম। এই মতবাদ বলে যে, আইসবার্গ এবং অন্য দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য শুধু লুকআউট অফিসারদের উপর ভরসা করে জাহাজ তার সর্বোচ্চ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিহাসের বিষয় যে লুকআউটদের কাছে কোনো বাইনোকুলারও ছিলনা। তাই রাতের বেলা যখন আইসবার্গ একদম নিকটে এসে পরে তখনই লুকআউট ফ্রেডরিক ফ্লিট তা দেখতে পান। তিনি সতর্ক সংকেত দিলেও ততক্ষণে আইসবার্গ অনেক কাছে চলে এসেছিল। ফার্স্ট ক্যাপ্টেন জাহাজ ঘুরানোর আদেশ দিলেও এত বড় জাহাজ ঘোরানো সহজ কথা নয়। তাই যা হবার তাই হল, আইসবার্গ  জাহাজের ডেক এবং ফ্রন্টবোর্ডে আঘাত করল। জাহাজের ওয়াটারটাইট কম্পারটমেন্টগুলো উচ্চতা কম থাকার কারণে নিজেদের কাজ করতে ব্যর্থ হল এবং পানি ঢুকে সেগুলো আইসকিউবের মত ভরে যেতে লাগল।

দুই ঘন্টা পরে জাহাজের ফ্রন্ট ডেক পানির নিচে চলে যায় এবং শুধু মাস্তুলটাই ভেসে থাকে। পুরো জাহাজটাই দুই টুকরো হয়ে যায়, মাস্তুলের প্রান্ত ভারী হওয়ায় সেটি কয়েক মিনিট ভেসে থেকেই প্রায়  শ‘খানেক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়।

জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষরা সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার দৃশ্যগুলো কল্পনা করে করে শিউরে উঠেন এখনো। সম্পূর্ণ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় লাইফ বোটের অভাব এবং ক্রুদের মধ্যে ভয় ও বিশৃঙ্খলাকে। পূর্বে ক্রুদের এমন দুর্যোগ নিয়ে কোনো অনুশীলন না করানোয় তারা এমন পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

সলিল সমাধি

সবচেয়ে কাছের জাহাজটি ছিল কারপেথিয়া, সেটি আইসবার্গের ভয়কে উপেক্ষা করে মানুষদের বাঁচানোর জন্য পূর্ণ শক্তিতে ছুটে এসেছিল। কিন্তু তাও পৌঁছাতে সকাল ৪ টা বেজে যায় এবং ততক্ষণে বেঁচে যাওয়া মানুষরা সমুদ্রের ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল প্রায়। মাত্র ৭০০’র মত লোক বেঁচে যেতে পেরেছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল প্রথম শ্রেনীর যাত্রী। ক্যাপ্টেন স্মিথ এবং ইঞ্জিনিয়ার এডওয়ার্ড জাহাজে মারা গেলেও ব্রুস ইসমে ভাগ্যের জোরে একটা লাইফবোটে উঠে বেঁচে যান।

কারপেথিয়া শুধু কয়েক’শ জন মানুষের লাশকে জাহাজে তুলে নিতে সক্ষম হয়, বাকিরা সমুদ্রে ভেসে যায়। টাইটানিকের জাহাজ ডুবির প্রায় দুই তিনমাস পরেও অনেক দূরবর্তী উপকুলে যাত্রীদের লাশ পাওয়া যেতে থাকে। প্রাপ্ত লাশ থেকে যেগুলোকে শনাক্ত করা গিয়েছিল তাদের আত্মীয়-স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং বাকিগুলো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়।

ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার এবং নানা মতবাদ

১৯৮৫ সালে ইউনিভার্সিটি অফ রোড আইসল্যনাড ইন্সটিটিউশন এর ওশানোগ্রাফির প্রফেসর এবং উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইন্সটিটিউশনের প্রফেসর রবার্ট ব্যালারড অনেকবছর ধরে খোঁজাখুঁজির পরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন।

এই আবিষ্কারের ফলে আবার নতুন করে উঠে আসে টাইটানিক ধ্বংসের কারণ নিয়ে নানা থিওরি। সাংবাদিক সিনান মলনি বলেন যে, সমুদ্র যাত্রার আগে টাইটানিকের কয়লার বাংকারে আগুন ধরে গিয়েছিল এবং তিন সপ্তাহ পর্যন্ত এটি কেউ খেয়াল করেননি।এতে জাহাজটির সম্মুখভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে সমুদ্র যাত্রায় আইসবার্গের আঘাতে এটি ভেঙে যায়। কিন্তু অনেক এক্সপার্ট মলনির এই মতবাদ বাতিল করে দেন।

তবে লেখক রবিন গারডিনার তার “টাইটানিক; দি শিপ দ্যাট নেভার স্যাঙ্ক” এই বইয়ে এক বিতর্কিত মতবাদ প্রকাশ করেন। তার মতে, টাইটানিক জাহাজটি ডুবেনি, ডুবেছিল টাইটানিকের ছদ্মবেশে থাকা একই কোম্পানির অলিম্পিক জাহাজটি।

রবিন গারডিনার যে অলিম্পিক জাহাজের কথা বলেছেন, সেটি ১৯১১ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু করে। টাইটানিক যে রুট দিয়ে যাতায়াত করত অলিম্পিকেরও একই রুট ছিল। ব্রিটিশ ক্রুজার আরএমএস হকের সাথে সংঘর্ষের আগে পর্যন্ত অলিম্পিক ৪ বার সফলভাবে যাত্রা সমাপ্ত করে। স্টারবোরড সাইডে দুইটি বড় গর্তের ফলে ওয়াটারটাইট কম্পারটমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অলিম্পিক নিজের শক্তিতে সাউদাম্পটন বন্দরে পৌঁছতে সক্ষম হয়। পরে রয়্যাল নেভি তদন্ত বোর্ড স্টার লাইন কর্তৃপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং বিশাল অঙ্কের জরিমানা এবং ক্ষতিপূরণ দিতে বলে।

মিস্টার গার্ডেনারের মতে, এই লোকসানের হাত থেকে বাঁচার জন্যই হোয়াইট স্টার লাইন কোম্পানি এই জাহাজডুবি নাটকের আশ্রয় নেয়। কোম্পানির ইনস্যুরেন্স এজেন্ট লয়েডস অফ লন্ডন জরিমানা দিতে নানা তালবাহানা করা আরম্ভ করে। এই সুযোগে নতুন বানানো টাইটানিক জাহাজের থেকে বিভিন্ন অংশ খুলে এনে অলিম্পিক জাহাজে জুড়ে দেওয়া হয় এবং অলিম্পিক জাহাজ টাইটানিক নামে যাত্রা শুরু করে।

পরিকল্পনা ছিল যে মাঝ সমুদ্রে পৌঁছালেই জাহাজের সি-কক খুলে দেওয়া হবে, এতে আস্তে আস্তে জাহাজ ডুবে যাবে এবং আগে থেকে অপেক্ষা করে থাকা আরেকটি জাহাজে সবাই উঠে যাবে। পরে, টাইটানিক জাহাজ ডুবে যাওয়ায় হোয়াইট স্টার লাইনের এতবড় জরিমানা মৌকুফ হয়ে যাবে। কিন্তু বিধি বাম, সেটি আর হয়ে উঠেনি।

গারডিনার আরো বলেন যে, শুধু আইসবার্গের ধাক্কায় এতবড় দুর্ঘটনা ঘটবেনা। আইসবার্গের সাথে ধাক্কা খাওয়ার সাথে সাথে এই জাহাজটি একটি উদ্ধারকারী জাহাজের সাথেও ধাক্কা খায় এবং এতে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

টাইটানিক নয় বরং অলিম্পিক জাহাজ ডুবে গিয়েছিল এই মতবাদের প্রমাণ হিসেবে তিনি টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ট্রায়ালের কথা উল্ল্যেখ করেন। যেখানে অলিম্পিকের ট্রায়াল হয়েছিল দুইদিন ধরে, সেখানে টাইটানিকের ট্রায়ালের সময়ব্যাপ্তি ছিল মাত্র ১২ ঘণ্টা। তিনি আরো দাবি করেন যে, টাইটানিক জাহাজটি অলিম্পিক জাহাজের ছদ্মবেশে আরো ২৫ বছর সার্ভিস দিয়েছিল নৌপথে। রবিন গারডিনারের এই মতবাদের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতবাদ এসেছে এবং জনপ্রিয় “টাইটানিক”ওয়েবসাইট ব্যাখ্যা করেছে যে গারডিনারের মতবাদ কেন ভুল। এরপরেও এসেছে আরো অনেক মতবাদ, অনেক বই-পুস্তক এবং টাইটানিক নামের একটি বিখ্যাত সিনেমা পর্যন্ত।

কিন্তু আজো কেউ শতভাগ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। টাইটানিকের মতই সেই সত্য হয়তোবা তলিয়ে গেছে সমুদ্রের অতল তলে।

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker