কীর্তিমানদের মৃত্যু নেই। তাদের চলে যাওয়া মানে শারীরিক প্রস্থান কেবল। কর্মই তাদের বাঁচিয়ে রাখে অনন্তকাল। তেমনই এক কীর্তিমানের নাম আইয়ুব বাচ্চু। ছিলেন দেশীয় ব্যান্ড সংগীতের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। দেখতে দেখতে আজ ৩ বছর হয়ে গেলো। আজ আইয়ুব বাচ্চুর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান তিনি।
রুপালি গিটার ফেলে চলে গেছেন সবার প্রিয় এবি বস, কিন্তু আজও তিনি প্রাণবন্ত হয়ে আছেন ভক্তদের হৃদয়ে। আছেন রোজকার চর্চায়। জনপ্রিয় ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক হিসেবে। তার হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ব্যান্ডজগৎ, এদেশের চলচ্চিত্রও পেয়েছে অনেক শ্রোতাপ্রিয় গান। ১৯৭৮ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে গানের ভুবনে পথচলা শুরু করেন আইয়ুব বাচ্চু। এরপর ১০ বছর সোলস ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট হিসেবে কাজ করেন।
নব্বইয়ের দশকে যাত্রা শুরু হয় ‘ব্যান্ডদল এলআরবি’র। এর দলনেতা ছিলেন তিনি। মাত্র ৫৬ বছরের বাচ্চুর জীবনটি ছিল সঙ্গীত নিরীক্ষায় পূর্ণ, অ্যাকুইস্টিক বাদ্যযন্ত্রহীন লাগাতার গিটার, কিবোর্ড, ড্রার্মসে সয়লাব বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতকে তিনি ভিন্ন মাত্রা দেখান ‘ফেরারী মন’ অ্যালবামে শুধু গিটার বাজানো আর গান গাওয়াই পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। অনেক বৈরীতার এ দেশে তা সম্ভবও করেছিলেন। কিন্তু পথটা মসৃণ ছিল কি? চট্টগ্রামে ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট যে পরিবারে বাচ্চুর জন্ম তা ছিল রক্ষণশীলতায় মোড়ানো। শৈশবে একটি গিটার কেনার জন্য সংগ্রাম করতে হয় তাকে। স্বীয় ধ্যানে এই ছয়টি তারকে ভালোবেসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান তিনি। পরিণত বয়সে তার নাম হয় “গিটারের জাদুকর”।
আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম একক অ্যালবাম ছিল রক্তগোলাপ (১৯৮৬)। যুক্ত ছিলেন সোলসের সঙ্গে। পরে গঠন করেন ব্যান্ড এলআরবি। ১৯৯২ সালে বাজারে আসে এলআরবি’র অভিষেকেই প্রথম ডবল অ্যালবাম। এরপর এলআরবি আর বাচ্চু মিলে বাংলা গানের ইতিহাসে নাম খচিত করার পালা। ধারাবাহিকভাবে দেশের তারুণ্য মেতে ওঠে এলআরবি’র সৃষ্টিতে।
একে একে দেশের অডিও ইন্ডাস্ট্রি কাঁপে তার বিভিন্ন অ্যালবামে। সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), ফেরারী মন (১৯৯৬), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০০), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নেই (২০০৫), স্পর্শ (২০০৮), যুদ্ধ (২০১২) আইয়ুব বাচ্চুর অমিত সঙ্গীত সৃষ্টি শুধু এলআরবি’কে ঘিরেই চলেনি। নিজের সলো ক্যারিয়ারেও ভাস্বর তিনি। একক অ্যালবামসমূহের মধ্যে নাম নেয়া যায় নিচের গুলোর: রক্তগোলাপ (১৯৮৬), ময়না (১৯৮৮), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৮), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কি! (২০০২), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬) , জীবন (২০০৬), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮), বলিনি কখনো (২০০৯), জীবনের গল্প (২০১৫)। বাচ্চুর ছোঁয়াতে জীবন পাওয়া গিটারের ঝংকার মেলে ২০০৭ এর গিটার ইন্সট্রুমেন্টাল অ্যালবাম ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’ এ। বহু মিশ্র অ্যালবামে সম্পৃক্ত ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। প্রিন্স মাহমুদের সুরে কিছু গান আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয় হয়। মূলত একজন রকার হয়েও গায়ক হিসেবে বাংলা ছবিতে গান গেয়েছেন তিনি। তার ‘আম্মাজান’ গানটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে জনপ্রিয়তার মাইলস্টোন স্পর্শ করে।
মাত্র ৫৬ বছরের বাচ্চুর জীবনটি ছিল সঙ্গীত নিরীক্ষায় পূর্ণ। অ্যাকুইস্টিক বাদ্যযন্ত্রহীন লাগাতার গিটার, কিবোর্ড, ড্রামসে সয়লাব বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতকে তিনি ভিন্ন মাত্রা দেখান “ফেরারী মন” অ্যালবামে। দেশের বরেণ্য বেহালা শিল্পী সুনীল চন্দ্র দাশের সঙ্গে যুগলবন্দি এর আগে শোনেনি বাংলা ব্যান্ড। অ্যালবাম দিয়ে হিট হয়েছিলেন বাচ্চু পরে। দেশজুড়ে লাইভ কনসার্টে তিনি আগে স্বীকৃতি পান তারকা স্টেজ পারফর্মারের। বাচ্চু ও সমসাময়িক ব্যান্ডগুলো প্রভাবে অপসংস্কৃতির তকমা থেকে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত বিযুক্ত হয়। শুধু রাজধানী শহর নয়, জনপদের হাটে-মাঠে-গঞ্জে-গাঁওয়ে এলআরবি আর বাচ্চু একাকার হয়ে যান। এখানেই হয়তো এই মায়েস্ত্রোর অনিবার্যতা। যার সঙ্গীতের কাছে ফিরতে বারবার। প্রয়াণের পরে তো টের পাই আরও বিস্তৃত ও ব্যাপকমাত্রায় অবিনশ্বর আইয়ুব বাচ্চু।
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts to your email.